কালো টাকা সাদা করার ‘অবাধ’ সুযোগ থাকছে না

পুঁজিবাজারসহ বেশ কয়েকটি খাতে কালো টাকা হিসেবে অধিক পরিচিত ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ সাদা করার অবাধ সুযোগ আর থাকছে না।

জেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 June 2021, 08:49 PM
Updated : 3 June 2021, 08:49 PM

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা বা বৈধ করার বিষয়ে কিছু বলেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের অর্থবিলেও এই বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

গত বাজেটে শুধু চলতি অর্থবছরের জন্য কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্ন ছাড়াই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

এই কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা বলছেন, কোথাও কোনো ঘোষণা বা প্রস্তাব বা কিছু উল্লেখ না থাকায় আগামী অর্থবছরে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার বিদ্যমান অবাধ সুযোগ আর থাকবে না।

দেশের প্রধান রাজস্ব আহরণকারী প্রতিষ্ঠানটির একজন ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন করে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। চলতি অর্থবছরে যেসব খাতে এমন সুযোগ আছে, তা আগামী ৩০ জুন শেষ হয়ে যাবে।

“আগের ঘোষণা অনুযায়ী, হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এবং জমি ও ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে এমন সুযোগ থাকছে।”

হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়াও চলতি অর্থবছরে জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের উপর প্রতি বর্গমিটারের উপর নির্দিষ্ট হারে এবং গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজের উপর ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়।

এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় অর্থমন্ত্রীকে।

নতুন করে কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা না দেওয়ায় সরকারকে ‘সতর্ক সাধুবাদ’ জানিয়েছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি।

দেশের অর্থনীতির বিরাট অংকের অর্থ কালো টাকা হিসেবে রয়েছে বলে বিভিন্ন সময় গবেষক ও অর্থনীতি বিশ্লেষকরা দাবি করে আসছেন।

এসব অর্থই মূলস্রোতে আনার যুক্তি দেখিয়ে মাঝেমাঝেই ‘প্রশ্নহীনভাবে’ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ করে দেয়া হয় বলে তাদের সমালোচনা।

এতে সৎ করদাতারা নিরুসাহিত হন বলে তারা এই সুযোগ না দিতে বরাবরই সরকারকে আহ্বান জানিয়ে আসছেন।

চলতি অর্থবছর অবারিত সুযোগ দেওয়ার সুবিধা বেশ ভালোই ব্যবহার করেছেন অনেকে। বড় অংকের কালো টাকা সাদা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।

বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় নিজেও বলেছেন, চলতি অর্থবছর অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে সুযোগ দেওয়ায় পুঁজিবাজার শক্তিশালী হয়েছে।

তিনি বলেন, “ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত ৩১১ জন করদাতা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগপূর্বক ৪৩ কোটি ৫৪ লাখ ৫২ হাজার ৯৮ টাকা আয়কর পরিশোধ করেছেন।“

অর্থমন্ত্রী আরও জানান, অপ্রদর্শিত অর্থ রিটার্নে প্রদর্শনের সুযোগের আওতায় ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত ৯ হাজার ৬২৩ করদাতা অপ্রদর্শিত সম্পদ রিটার্নে প্রদর্শনপূর্বক ১ হাজার ৩৮৬ কোটি ১০ লাখ ২ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা আয়কর পরিশোধ করেছেন।

এতে মহামারীতে অর্থনীতিতে পুঁজির প্রবাহ বেড়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, প্রশ্নহীনভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ উঠে গেলেও আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ‘প্রযোজ্য হারে’ আয়কর ও জরিমানা দিতে হবে এবং অর্থের উৎস জানাতে হবে।

গতবছর বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যে অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে আয়কর অধ্যাদেশে দুটি ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করেন, যাতে ঢালাওভাবে ‘কালো টাকা’ সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়।

সেসময় অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, “দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন আগামী ১ জুলাই ২০২০ থেকে ৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাগণ আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের উপর প্রতি বর্গমিটারের উপর নির্দিষ্ট হারে এবং গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজের উপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না।”

এবার বাজেটে এই বিষয়ক ঘোষণা না থাকায় বৃহস্পতিবার টিআইবি এক বিবৃতিতে বলেছে, “২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থের মোড়কে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দানের বিষয়ে নতুন করে ঘোষণা না দেয়াকে সতর্ক সাধুবাদ জানাচ্ছে টিআইবি।

“পাশাপাশি সৎ করদাতাদের প্রতি বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক এই সুবিধা যেন অন্য কোনো উপায়ে আয়কর অধ্যাদেশে রাখা না হয় সে বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করছে প্রতিষ্ঠানটি।“

বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সব মহলের তীব্র আপত্তি ও প্রতিবাদ স্বত্ত্বেও চলতি বাজেটে অর্থমন্ত্রী কালো টাকা বৈধ করার যে ঢালাও সুবিধা দিয়েছিলেন সেটি আসন্ন বাজেটে নতুন করে না রাখার সিদ্ধান্ত সরকারের বোধোদয় হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে।

“এক্ষেত্রে আমরা বিশ্বাস করতে যাই যে সরকারপ্রধানের ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা’র বক্তব্যকে সম্মান করে শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ এই অনৈতিক সুবিধাটি আয়কর অধ্যাদেশের আইনি মারপ্যাঁচে ফেলে বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর চাপে পড়ে অব্যাহত রাখবে না।”

পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "কালো টাকা সাদা করার বিষয়টি যদি রহিত করা হয়ে থাকে, এটা ভালো দিক।”

আরও পড়ুন