বিচ্ছেদের পর বিপুল অর্থ কোথায় কাজে লাগাবেন মেলিন্ডা গেটস

একসঙ্গে তারা ছিলেন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী দম্পতি, সেই সঙ্গে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় দাতা জুটি। বিচ্ছেদের পরও বিল ও মেলিন্ডা গেটস থাকবেন বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায়।   

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2021, 02:38 AM
Updated : 13 May 2021, 02:38 AM

সেবামূলক কাজে কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা মোটামুটি দাতব্য কর্মকাণ্ডের ‘রোল মডেলে’ পরিণত করেছে মেলিন্ডা গেটসকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিলের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ জনহিতকর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় শুরুর সুযোগ করে দিয়েছে।

সম্পদ ব্যবস্থাপনার কোম্পানি মেরিয়ান ভেঞ্চার্সের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা অংশীদার অ্যালেক্সিস ডে রাড সেইন্ট জেমস সিএনএনকে বলেন, “কোনো কাজে প্রভাব রাখার ক্ষেত্রে তার সক্ষমতা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। জনহিতকার কাজে এটা সম্ভবত এককভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”

অতীতে মেলিন্ডা গেটসকে কয়েক ধরনের জনহিতকার কাজেই মনযোগী হতে দেখা গেছে। আগামী দিনে তাকে কোন কোন বিষয়ে আগ্রহী হতে দেখা যেতে পারে, তার অতীতের কাজ থেকেই তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে সিএনএন এর এক প্রতিবেদনে।

নারীর ক্ষমতায়ন

নারীকে সহায়তা করা, আর তার ক্ষমতায়ন অতীতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মেলিন্ডা গেটসের কাছে। সেই পথ ধরেই ২০১৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পাইভোটাল ভেঞ্চার্স নামে নিজের একটি কোম্পানি, যার কাজ বিনিয়োগ এবং নতুন উদ্যোগে সহায়তা করা।

২০২০ সালের মার্চে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সিএনএনে এক নিবন্ধে মেলিন্ডা গেটস বলেন, “আমি আর বিল মিলে আমাদের ফাউন্ডেশন খোলার পর আমি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে নারীদের সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করি। আর তখনই নারী ও কম বয়সী মেয়েদের জীবনে বৈষম্যের প্রভাব নিয়ে আমার ধারণা স্পষ্ট হতে থাকে।”

তার ভাষায়, “এই চিত্র সবখানেই এক: তুমি পৃথিবীর কোথায় জন্মেছ সেটা বিষয় না, যদি তুমি মেয়ে হয়ে জন্মাও, তোমার জীবন কঠিন হয়ে যাবে।”

সেবা কার্যক্রম এবং নতুন উদ্যোগে বিনিয়োগ করে মেলিন্ডা গেটসের কোম্পানি নারীকেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রচেষ্টায় সহায়তা দিয়েছে। প্রযুক্তি এবং এর মত মূলধারার সব খাতে নারীর কাজকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয় পাইভোটাল ভেঞ্চার্স। স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ে নারীদের জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসার বিষয়েও উৎসাহী করা হয়।

২০২০ সালের জুনে পাইভোটাল ভেঞ্চার্সের মাধ্যমেই ‘ইকুয়ালিট ক্যান’ট ওয়েট চ্যালেঞ্জ’ কর্মসূচি চালু করার জন্য তিনি জোট বেঁধেছেন প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা জেফ বেজোসের সাবেক স্ত্রী সমাজসেবী ম্যাকেঞ্জি স্কটের সঙ্গে।

২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে নারীর ক্ষমতা এবং প্রভাব বলয় আরও সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে সেরা আইডিয়াগুলো যারা আনবেন, এ কর্মসূচির আওতায় তাদের তিন কোটি ডলার সহায়তা দেওয়া হবে।

এ প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বের জন্য ১০টি উদ্যোগকে এরই মধ্যে বাছাই করা হয়েছে। শিগগিরই চূড়ান্ত বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে।

দাতব্য সংস্থা ‘শি ইজ দ্য ফার্স্ট’ এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ট্যামি টিবেটস সিএনএন বিজনেসকে বলেন, “আমার মনে হয়, মেলিন্ডার সেবামূলক কাজ থেকে একজন সাধারণ মানুষেরও অনেক কিছু শেখার আছে। লিঙ্গ বৈষম্য ঘোচানোর প্রশ্নে এবং নারী ও কিশোরীদের সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বরাবরই অবিচল।”

মানসিক স্বাস্থ্য

পাইভোটাল ভেঞ্চার্সের মাধ্যমে মেলিন্ডা গেটস মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়েও বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন, যার বেশিরভাগই তরুণদের কেন্দ্র করে।

মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ‘সাউন্ড ইট আউট’ নামে একটি প্রচারাভিযান শুরুর জন্য সহায়তা দেন তিনি।

কিশোর বয়সীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ সহায়তা দিতে ২০২০ সালের অক্টোবরে তিনি চালু করেন ‘দ্য আপসুইং ফান্ড ফর অ্যাডোলেসেন্ট মেন্টাল হেলথ’। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ এবং সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামী তরুণদের সহায়তা দেওয়াই এ তহবিলের মূল লক্ষ্য।

টিকা এবং টিকা প্রাপ্তির অধিকার

কোভিড-১৯ মহামারীর বিরুদ্ধে লড়তে টিকাদান এবং টিকার সুষম বণ্টন নিয়ে মেলিন্ডা গেটস শুরু থেকেই উচ্চকণ্ঠ।

গত ডিসেম্বরে সিএনএন এর সাংবাদিক পপি হারলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “এই টিকা প্রত্যেকের প্রয়োজন। যদি টিকা শুধু ধনী দেশগুলোতে দেওয়া হয়, এই রোগ তাহলে আবার ফিরে আসবে। আমাদের তখন দ্বিগুণ মৃত্যু দেখতে হবে। টিকা যদি সবাইকে দিতে না পারি, তাহলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া আরও ধীর হয়ে যাবে।”

২০০৩ সালে মোজাম্বিকে বিল গেটস ও মেলিন্ডা গেটস।

আর এমনিতেই ঝুঁকিতে থাকা নারীরা এই মহামারীর কারণে যাতে নতুন করে আরেকটি সঙ্কটে না পড়ে, সেজন্য দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পথ খুঁজতে নীতি নির্ধারকদের তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারীর সঙ্কট উত্তরণে বিল অ্যান্ড মেলিন্ড গেটস ফাউন্ডেশন এ পর্যন্ত ১৭৫ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

দারিদ্র্য দূরীকরণ

বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের দীর্ঘদিনের কাজের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হল মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করা।

প্রযুক্তি এবং দারিদ্র্যের ব্যবচ্ছেদ করে ২০১৮ সালের অক্টোবরে সিএনএন বিজনেসে লেখা এক নিবন্ধে মেলিন্ডা গেটস বলেন, “প্রথম কাজটি হতে হবে সব মানুষের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত করা। এবং এখনও কোটি কোটি মানুষ তা পাচ্ছে না।

“দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তি কোনো কাজে আসবে না, যদি নেই প্রযুক্তি পেতে গিয়ে মানুষকে দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে হয়।”

দারিদ্র্য বিশেষ করে কীভাবে নারীদের ওপর প্রভাব ফেলে, সে বিষয়েও মনযোগ দিয়েছেন মেলিন্ডা গেটস। ২০১৯ সালে তিনি বলেন, গর্ভনিরোধক পাওয়ার সুযোগ বিস্তৃত করা হলে তা দারিদ্র্য মোকাবিলায় বিশ্বের ‘সবচেয়ে বড় অস্ত্র’ হিসেবে কাজ করবে।

সবেতন ছুটি

যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় একটি ছুটি নীতি প্রণয়নের জন্য ২০১৬ সাল থেকে পাইভোটাল ভেঞ্চার্সের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান দলের আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আসছেন মেলিন্ডা গেটস।

আর এই লক্ষ্যে ‘বাইপার্টিজান পলিসি সেন্টার অ্যান্ড দ্য ন্যাশনাল পার্টনারশিপ ফর উইমেন অ্যান্ড ফ্যামিলিস’ কর্মসূচিসহ আইনি সহায়তার জন্য সাড়ে ছয় কোটি ডলার তিনি দিয়েছেন।

‘পেইড লিভ ফর অল’ এবং ‘পিল+ইউএস’ (পেইড লিভ ফর দ্য ইউএস) এর সঙ্গেও কাজ করে তার প্রতিষ্ঠান। ভোটার, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য অংশীজনদের উদ্বুদ্ধ করে একটি জাতীয় নীতির জন্য চাপ তৈরি করতে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রচার চালায় ওই দুটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান।

২০১৯ সালের মে মাসে সিএনএনে এক সাক্ষাৎকারে মেলিন্ডা গেটস বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি-তহবিলের মাধ্যমে সবেতন পারিবারিক ছুটি বাস্তবায়ন করা দরকার। আর কংগ্রসের উচিৎ বিভিন্ন রাজ্যের নীতিগুলো থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে এ বিষয়ে একটি নতুন নীতির প্রস্তাব সামনে নিয়ে আসা।

তিনি বলেন, “আমরাই একমাত্র শিল্পোন্নত রাষ্ট্র, যাদের এই ছুটির ব্যবস্থা নেই। এটা অনেক বড় ব্যবধান তৈরি করে দিয়েছে।”