‘বঙ্গবন্ধুর পথ নকশায় উত্তরণের সোপানে বাংলাদেশ’

স্বাধীনতার পর সাহায্য নির্ভর বাংলাদেশের পরিচয় থেকে বেরিয়ে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠনের যে পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন, তার পথ ধরেই ৫০ বছরের মাথায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বলে মনে করেন কয়েকজন অর্থনীতিবিদ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2021, 01:13 PM
Updated : 14 March 2021, 01:24 PM

রোববার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্যাটেজিক স্ট্যাডিজ-বিআইআইএসএস আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধুর ভিশন অব সোনার বাংলা’ শীর্ষক সেমিনারে তারা এ বিষয়ে আলোচনা করেন। 

অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ, বিনায়ক সেন ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান আলোচনায় অংশ নেন।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর দেখানো ‘ভিশনের’ পথ ধরেই বাংলাদেশ সাহায্যনির্ভর অর্থনীতি থেকে বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়। স্বাধীনতার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলাই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মূল বিষয়।

“পাকিস্তানের সময় প্যারিস কনসোর্টিয়াম ছিল প্রধান বার্ষিক আয়োজন, যেখানে দাতা দেশগুলো পাকিস্তানকে কী দেবে না দেবে সেটা নিয়ে আলোকপাত করা হত। বাংলাদেশ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ চিন্তা করলেন এই মিটিংটা ঢাকায় হতে হবে। সাহায্য নির্‌ভরতা থেকে বেরিয়ে আমাদেরকে বাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে, রপ্তানি বাড়াতে হবে। এটা ছিল প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কৌশল।”

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৯৯০ সালের দিকেও বাংলাদেশের রপ্তানি ও বৈদেশিক সাহায্যের অনুপাত মোটামুটি সমান সমান ছিল। মহামারীর আগের বছরে রপ্তানি ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার, রেমিটেন্স ছিল ১৭ বিলিয়ন ডলার। আর সাহায্য ছিল মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলার।

“এর মানে দাঁড়াল, ১৯৯০ সালের ১ অনুপাত ১ রেশিও থেকে গত বছর দাঁড়াল ১১ অনুপাত ১। পার্চেজিং পাওয়ার প্যারাইটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানি করেছি, রপ্তানি করেছি ৫৭ বিলিয়ন ডলারের। এইড বার্ডেন বা ঋণ দায় ৬০ বিলিয়ন ডলার… এটা জিডিপির ২০ শতাংশের কম।

“বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে যে, গত পাঁচ দশকে বঙ্গবন্ধুর ভিশন অনুযায়ী, আমরা সাহায্য নির্ভর অর্থনীতি থেকে বাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত হতে পেরেছি।”

এই উত্তরণে সরকারের ভূমিকা কী? সিপিডির সম্মানীয় ফেলো বলছেন, বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা, ব্যাক টু ব্যাক এলসি চালু করার বিষয়গুলো রপ্তানি শিল্পের ওপর ভালো ভূমিকা রেখেছে। প্রণোদনা ও নীতি সহায়তাগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

“আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জিরো ট্যারিফ মার্কেট একসেস পেয়েছিলাম। এটাও উত্তরণে ভূমিকা রেখেছে। বিশ্বের অনেক স্বল্পোন্নত দেশ এটা পায়নি। আমাদের ব্যবসায়ী সমাজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। প্রোডাকশনভিত্তিক অর্থনীতি থেকে মেনুফ্যাকচারিং ভিত্তিক অর্থনীতি দাঁড় করিয়েছেন তারা।  নিট, অ্যাপারেলস, ফার্মাসিউটিক্যালস, লেদার, জুট- এগুলো।“

অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করতে দক্ষ জনশক্তি এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থাকেও যুগের চাহিদা অনুযায়ী সাজাতে হবে; ভালো বেতনের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু কৃষির ওপর গুরুত্ব দিয়ে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন। বাংলাদেশের আজকের অবস্থানের পেছনে ভূমিকা রেখেছে কৃষি উন্নয়ন, শিল্প এবং কৃষিতে প্রযুক্তির সংযোজন।

“রপ্তানিমুখী শিল্পের পাশাপাশি গত ১০ বছরে স্থানীয় বাজার নির্ভর অর্থনীতিও জোরদার হয়েছে। এছাড়া ভূমিকা রেখেছে রেমিটেন্স। দারিদ্র্যের হার ৮০ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশে নামাই বাংলাদেশের অগ্রগতির গল্প।”

দেশের উন্নতি হলেও ধনী দরিদ্র্যের বৈষম্য নিয়ে সতর্ক করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “এখন দেশে দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বাড়ছে। দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। গত ১৫ বছরে আড়াই কোটি বাংলাদেশি দারিদ্র্যসীমা থেকে বেরিয়ে এসেছে।

“দারিদ্র্য কমার পাশাপাশি ধনী দরিদ্র্যের বৈষম্যটা বেড়ে গেছে। ১৯৯১ সালের পর থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এটা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।… এখন সম্পদের পুনঃবন্টন করতে হবে। ধনীর কাছ থেকে নিয়ে গরীবদের মাঝে বণ্টন করতে হবে। সেজন্য ট্যাক্স কালেকশন আরও বাড়াতে হবে। শুধু শিক্ষিত শ্রেণির কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা না করে সব শ্রেণির মানুষের কথা ভাবতে হবে।”

অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জামান বলেন, উন্নয়ন করতে হলে সব শ্রেণির মানুষের কথা চিন্তা করেই এগোতে হবে। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন চিন্তা ছিল সব শ্রণির জন্য। কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তার উন্নয়ন চিন্তা ও স্বনির্ভরতার পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন।

“আজকের বাস্তবতাতেও কৃষি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। চলমান মহামারী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সেই বিষয়টি আবারও প্রমাণ হয়েছে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশে প্রচুর দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। পাশাপাশি দুর্নীতিও শতভাগ দূর করতে হবে।”

প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ভিশন ছিল ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটার আলোকে। তাই তার ভিশন ছিল খুবই স্পষ্ট। এটা কোনো তত্ত্ব ছিল না। এটা ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে।

“স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানটাও সেভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। ৫০ বছর পর আমরা যখন উন্নয়নশীল দেশের সারিতে এলাম, তখন সেই পরিকল্পনটা উপলব্ধি করার সময় হয়েছে।”

অর্থনৈতিক মুক্তির দ্বার উন্মোচিত হলেও বাহাত্তরের সংবিধানের অনেক কিছু এখনও বাস্তবায়ন হয়নি মন্তব্য করে গওহর রিজভী বলেন, “সেক্যুলার সমাজ নির্মাণ ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম আকাঙ্ক্ষা। আমাদের সমাজ এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এখনও রয়ে গেছে ধর্মীয় বৈষম্য, অহিষ্ণুতা এখনও স্পষ্ট।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন বিআইআইএসএস এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. এমদাদ উল বারী।