তখন কর্তার ইচ্ছেমাফিক একনেক সভা হত: পরিকল্পনামন্ত্রী

দীর্ঘ দিন বাংলাদেশের প্রশাসনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে আসা পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে তৎকালীন সরকার প্রধানদের ‘খামখেয়ালিপনার’ চিত্র তুলে ধরেছেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Feb 2021, 03:05 PM
Updated : 23 Feb 2021, 03:05 PM

মঙ্গলবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিল অবহিত সভা হয়। সভায় গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে একনেক সভার প্রস্তুতি ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে আলোচনায় কয়েক দশক আগের অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করেন এমএ মান্নান।

তিনি বলেন, “জাতির পিতাকে হত্যার পর যখন পরিকল্পিত পথ থেকে সরে গেল তখন প্ল্যানিং কমিশন ছিল এক ধরনের, মাথায় বাড়ি খেয়ে যখন মাছ পড়ে যায় ওই ধরনের অবস্থায় ছিল। হয়ত মরে নাই।”

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “আজকাল যখন আমরা ঘড়ির কাঁটার মতো যেভাবে দেখছি মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় (একনেক মিটিং), এভাবে ছিল না। আমি দূর থেকে দেখেছি। তখন আমি জুনিয়র অফিসার ছিলাম। তখন কর্তা ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল। কাগজের উপরে নয়।

“তখন কর্তা ব্যক্তি বলতেন যে, আমি সভা করব। তখন সবাই দৌড়ে গিয়ে কাগজ টাগজ বের করে সভা নির্ধারণ করতেন। এখানে (এনইসিতে) আসতেন। কিন্তু এখন কর্তা ব্যক্তির নির্দেশের আগেই তৈরি থাকতে হয়, কারণ সভা হবে। এখানে অ্যাটিচ্যুডের কম বেশি আছে।”

ওই সব সভা কীভাবে হত তা তুলে ধরে সাবেক এই আমলা বলেন, “আমি দেখেছি আগে এক সভায় ২০-৩০টা বিষয় থাকত আলোচনার জন্য। শুরু হত এক ঘণ্টা-দুই-আড়াই ঘণ্টা পরে। এরপর দুই-তিনটার পরে কর্তা ব্যক্তিরা টায়ার্ড হয়ে যেতেন। আচ্ছা আজকে থাক, দেখা যাবে। পরে বারান্দায় কান্নাকাটি হত, আহারে আমার প্রকল্পটা গেল না! আমরা এগুলোই শুনতাম।

“এরপর আগামী একনেক কবে হবে জানি না। তখন দৌড়ঝাঁপ শুরু হত। কারণ (পরের সভা) কবে হবে নির্ধারিত কেউ বলতে পারত না।”

সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই জানিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “এখন একনেক বৈঠক কবে হবে আমি জানি। প্রত্যেক মঙ্গলবারে একনেক বৈঠক হবে।

“এখন সপ্তাহের প্রত্যেক মঙ্গলবারে একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট সবাই ওই দিনের বৈঠকে কী কী বিষয় বা উন্নয়ন প্রকল্প উপস্থাপন করা হবে, তা নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে কার্যক্রম চালিয়ে বিষয়টি প্রস্তুত করা হয়। এরপর ঠিক ১০টা বা সাড়ে ১০টায় বৈঠকে বসে এসব উন্নয়ন প্রকল্প বিশ্লেষণ করে অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।”

মন্ত্রী বলেন, “পরিকল্পনা শুধু কাগজটাকে নির্দিষ্ট হতে হবে না, প্রক্ষেপণটাকে নির্দিষ্ট হতে হবে না। যে কাঠামোর মধ্যে এটা অপারেট করবে সেটাকে সুনির্দিষ্ট হতে হবে। সেটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গত ১০ বছর যাবত দেখিয়েছেন। এটা একটা বিশাল ব্যাপার।”

রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য অধ্যাপক ড. শামসুল আলম।

তিনি বলেন, “নব্বইয়ের দশকে দেশে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গুরুত্বহীনভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। এরপর ২০০২ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত আট বছর দেশে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ছিল না। সেখান থেকে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবারও পরিকল্পিতভাবে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

“২০১০ সাল থেকে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন প্যারাডাইম শিফট হয়েছে। দেশে বর্তমানে যে উন্নয়ন সফলতা পাচ্ছে, তার মূলে রয়েছে পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর চেষ্টা।”

এ সময় তিনি চলমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়কে নিজেদের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মধ্যবর্তী মূল্যায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

এর আগে অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের যুগ্ম প্রধান মো. মাহবুবুল হক পাটওয়ারী।

তিনি বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাটি ইতোমধ্যেই গত ২৯ ডিসেম্বর একনেক সভায় অনুমোদন দিয়েছে সরকার। দলিলটি অবহিত করতেই এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি  ৮ দশমিক ৫১ শতাংশে উন্নীত করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনযাপন সহজ করতে গড় মূল্যস্ফীতি ৪ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।

এই পথ পরিক্রমায় করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ৫ দশমিক ২০ শতাংশে নেমে যাওয়া জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে পাঁচ বছরে যথাক্রমে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ, ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৫১ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।

এছাড়া ২০২৫ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ১০৬ ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়।

মাহবুবুল হক পাটওয়ারী বলেন, “এই আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বর্তমানে দেশের দারিদ্র্যের হার ২৩ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে।

“পর্যায়ক্রমে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে দারিদ্র্যের হার শুন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে পরিকল্পনায়।”

দলিলে বলা হয়, ২০২০ সালে মাথাপিছু আয় ৯ দশমিক ০৮ শতাংশ হারে বেড়েছে। এরপর ২০২১ সাল থেকে যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ, ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ, ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং দলিল বাস্তবায়নের শেষ বছর ২০২৫ সালে ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বাড়ানো সম্ভব হলে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।

এই পরিকল্পনায় দারিদ্র্য দূরীকরণ ত্বরাণ্বিত করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির জন্য শ্রমঘন রপ্তানি শিল্প এবং কৃষি পণ্যের বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তাদের গতিশীল করা, আধুনিক সেবা খাতকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা এবং বিদেশেও ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, আশানুরূপ কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দেশের মোট বিনিয়োগ জিডিপির ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এর মধ্যে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২৮ দশমিক ২ শতাংশ, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ৩ শতাংশে ও সরকারি বিনিয়োগ ৯ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।

বর্তমানে দেশে মোট বিনিয়োগ জিডিপির ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ মাত্র শূন্য দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ৮ শতাংশ।

জাতীয় সঞ্চয় জিডিপির ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৩৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি জিডিপির ৭৫ শতাংশ ভোগব্যয় ৭০ দশমিক ৩ শতাংশে নামানোর লক্ষ্যও রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশের দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ; আর চরম দারিদ্র্যের হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশ।

২০৪১ সালের মধ্যে দেশের দারিদ্র্যের হার শূন্যে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়ে সরকার ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করছে।