রপ্তানি আয়: ডিসেম্বরে আবার উল্টো রথ

করোনাভাইরাস মহামারীতে গত এপ্রিলে রপ্তানি আয় তলানিতে পৌঁছলেও এরপর ধীরে ধীরে বাড়ছিল, তবে ডিসেম্বরে এসে আবার হোঁচট খেয়েছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Jan 2021, 12:48 PM
Updated : 5 Jan 2021, 12:50 PM

করোনাভাইরাস মহামারীকালে বিদায়ী বছরের শেষ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৩১ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ।

এই অঙ্ক ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ।

ডিসেম্বরের এই ধসের কারণে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে সার্বিক রপ্তানি কমেছে শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ২ দশমিক ২৫ শতাংশ।

অথচ মহামারীর মধ্যেও অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি ছিল রপ্তানি আয়ে।

ইউরোপ-আমেরিকায় সংক্রমণের যে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে, তার প্রভাবেই রপ্তানি আয় হোঁচট খেয়েছে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারক ও অর্থনীতি গবেষকরা।

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি এভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে এসেছে। নতুন রপ্তানি আদেশ খুব বেশি আসছে না। যুক্তরাজ্যে নতুন ধরনের করোনাভাইরাস নতুন আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। কবে নাগাদ এ অবস্থা কাটবে বলা যাচ্ছে না।”

আগামী কয়েক মাস পরিস্থিতি খারাপই যাবে বলেই মনে করেন বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি পারভেজ।

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও একই কথা বলেন।

“বিভিন্ন দেশে লকডাউনের কারণে বিক্রি না হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে আগের পণ্য মজুদ রয়ে গেছে। এ অবস্থায় আগামীতে রপ্তানি আদেশ আরও কমবে বলে মনে হচ্ছে।”

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় পুরোটাই আসে পোশাক খাত থেকে

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর‌্যন্ত এই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে।”

তবে কোভিড-১৯ মহামারীর আগে গত অর্থবছরেও যে দেশে রপ্তানি আয় কমেছিল, তা মনে করিয়ে দিয়েছেন অর্থনীতির এই গবেষক।

তিনি বলেন, “ছয় মাসে দশমিক ৩৬ শতাংশ রপ্তানি আয় কমা খুব বেশি বিচলিত হওয়ার মতো বিষয় নয়। অর্থবছর শেষে যদি সামান্য প্রবৃদ্ধিও থাকে, সেটাকেই আমি বড় অর্জন বলে মনে করব।”

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) মঙ্গলবার যে হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ ১ হাজার ৯২৩ কোটি ৩৪ লাখ (১৯.২৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে।

এই ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ১ হাজার ৯৬৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৯৩০ কোটি ২১ লাখ ডলার।

সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৩১ কোটি ডলার আয় হয়েছে; লক্ষ্য ছিল ৩৫২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আয় হয়েছিল ৩৫২ কোটি ৯১ লাখ ডলার।

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১ হাজার ৫৫৪ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে কম ৪ দশমিক ১২ শতাংশ।

তবে এই ছয় মাসে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে। মোট আয় এসেছে ৮৫২ কোটি ৬১ লাখ ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে উভেন পোশাক রপ্তানিতে। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এই খাত থেকে আয় হয়েছে ৭০১ কোটি ৯৩ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ২২ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ কম।

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ দশমিক ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।

করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় গত এপ্রিলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় তলানিতে ঠেকেছিল; ওই মাসে সবিমিলিয়ে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল মাত্র ৩৬ কোটি ডলার।

বিধি-নিষেধ শিথিলে কারখানা খোলার পর মে মাসে রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়ে, জুনে তার চেয়ে অনেক বাড়ে।

এরপর চলতি ২০২০২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেও (জুলাই, অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর) সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল। অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ কমলেও নভেম্বরে দশমিক ৭৬ শতাংশ বেড়েছিল।

পাটের তৈরি এসব পণ্য রপ্তানিও হয়। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

পাট রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ৩০.৫৬%

এই সঙ্কটেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বড় প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।

জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৬৬ কোটি ৮১ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ২০ দশমিক ২৯ শতাংশ।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় করেছিল, যা ছিল আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।

অন্যান্য পণ্য

মহামারীকালে ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ১৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। কৃষি পণ্য রপ্তানি বেড়েছে দশমিক ১৮ শতাংশ। হস্তশিল্প পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৭০ শতাংশের বেশি।

তবে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে ১৭ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি কমেছে ৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ।

করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে চলতি অর্থবছরে ৪৮ বিলিয়ন (৪ হাজার ৮০০) মার্কিন ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে সরকার, যা গত অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করে, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে আয় কম ছিল ২৬ শতাংশ।