বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন পাকিস্তানের দ্বিগুণ

যে দেশের শোষণ-নিপীড়ন থেকে বাঁচতে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের মানচিত্র নিয়েছিল বাংলাদেশ, ৪৯ বছরে সেই পাকিস্তানের চেয়ে রিজার্ভ দ্বিগুণ করেছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2020, 04:08 PM
Updated : 15 Dec 2020, 04:09 PM

বাংলাদেশের বিজয়ের ৪৯তম বার্ষিকীর ঠিক আগে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের নতুন উচ্চতায় ওঠার খবর দেয়।

মঙ্গলবার দিন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ অবস্থান করছিল ৪ হাজার ২০৯ কোটি (৪২ দশমিক ০৯ বিলিয়ন) ডলারে, যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের তথ্যে দেখা যায়, ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন পাকিস্তানের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৬ ডিসেম্বরের আগের দিন রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।

“বিজয়ের এই মাসে পাকিস্তানের দ্বিগুণ রিজার্ভ এটাই প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ৪৯ বছরে অনেক এগিয়েছে।”

শুধু পাকিস্তানের চেয়েই নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকার চেয়ে আট গুণ বেশি এখন বাংলাদেশের রিজার্ভ।

সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সেদেশের রিজার্ভ ৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের রিজার্ভ সবচেয়ে বেশি। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১২ ডিসেম্বর ভারতের রিজার্ভ ছিল ৫৭৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার বড় বিজ্ঞাপন হিসেবে রিজার্ভকে এখন দেখাচ্ছে সরকার।

অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখতও বলেন, রিজার্ভে একটার পর একটা রেকর্ড কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় সরকারকে সাহস জোগাচ্ছে।

প্রবাসী এই কর্মীদের পাঠানো অর্থে স্ফীত হচ্ছে রিজার্ভ

রেমিটেন্স ও রপ্তানির উপর উপর ভর করে গড়ে ওঠা বিশাল রিজার্ভ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন হয় ডলারে, আর তা দিয়ে মেটানো হয় আমদানি ব্যয়।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়।

প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয়ের খরচ হিসাবে বর্তমানে হাতে থাকা রিজার্ভ দিয়ে প্রায় সাড়ে ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে বাংলাদেশ।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে হারিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তখন সদ্য স্বাধীন দেশটিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যায়িত করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।

আর এখন সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ অর্থনীতি ও মানব উন্নয়নের নানা সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে।

তবে এই দীর্ঘ পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। কখনও কখনও হোঁচট খেয়েছে। আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে।

রিজার্ভ ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে এলে ‘ভাবমূর্তি নষ্ট হবে’ বলে ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল বাকি রাখতে বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশ।

১২ কোটি ডলার থেকে শুরু

স্বাধীনতার পর প্রায় এক দশক বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়নের (রিজার্ভ) কোনো তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নেই।

প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায়, তা ৪০ বছর আগের ১৯৮১-৮২ অর্থবছরের, তখন রিজার্ভ ছিল ১২ কোটি ১০ লাখ ডলার।

পাঁচ বছর পর ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর শেষে সেই রিজার্ভ বেড়ে হয় ৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ১৯৯১-৯২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলারের ‘ঘর’ অতিক্রম করে ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে উঠে।

পরের ১৯৯২-৯৩ অর্থবছর শেষেই রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। ৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছর শেষে।

১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর শেষে তা কমে ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা আরও কমে ১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

এরপর ১৯৯৭-৯৮ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত রিজার্ভ দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের মধ্যে উঠানামা করে।

২০০০-০১ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। ওই অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার থাকলেও অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে তা ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। তখনই আকুর বিল পুরোটা পরিশোধ না করে অর্ধেক করা হয়েছিল।

এরপর অবশ্য কখনই রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি আসেনি। ২০০১-০২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে হয় ১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার।

২০০৫-০৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ৫ বিলিয়ন ডলার অত্রিক্রম করে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বেড়েই চলেছে অর্থনীতির এই সূচক।

২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। পরের বছর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১৬ সালের জুনে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

গত ৩ জুন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ জুন সেই রিজার্ভ আরও বেড়ে ৩৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ৩০ জুন রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। এক মাস পর ২৮ জুলাই রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরও অতিক্রম করে।

তিন সপ্তাহ পর গত ১৭ অগাস্ট রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ১ সেপ্টেম্বর ৩৯ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

৪০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়ায় ৮ অক্টোবর। তিন সপ্তাহ না যেতেই ২৯ অক্টোবর সেই রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন ডলারে উঠে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত এক বছরে রিজার্ভ বেড়েছে ১ হাজার কোটি ডলারের বেশি।

ডেপুটি গভর্নর ছাইদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের উপর ভর করেই রিজার্ভ নতুন এ উচ্চতায় উঠেছে। এছাড়া রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা এবং বিদেশি ঋণ-সহায়তা বৃদ্ধি রিজার্ভ বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।”