প্রণোদনা: ‘ছোটদের’ ঋণের অর্ধেকও বিতরণ হয়নি

নানা পদক্ষেপ-তাগিদেও কাজ হয়নি; করোনাভাইরাস সঙ্কটে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বড় উদ্যোক্তারা ঋণে ভাসলেও ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণ এখনও বাড়ানো যায়নি।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Dec 2020, 03:53 PM
Updated : 8 Dec 2020, 03:53 PM

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৯ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা বিতরণের জন্য অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিতরণ করা হয়েছে ৮ হাজার ২১৮ কোটি টাকা।

মহামারীর ক্ষতি সামলে উঠতে সরকার এখন পর্যন্ত সোয়া লাখ কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা থেকে বড় উদ্যোক্তারা তাদের বরাদ্দ ঋণ নিয়ে শেষ করে ফেলেছেন।

বড় উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে ব্যাংকগুলো উদার হলেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে চিত্র ভিন্ন। এজন্য ব্যাংকগুলোর অনীহাকে দায়ী করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় সোয়া লাখ কোটি টাকার মোট ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার।

এরমধ্যে সবচেয়ে বড় প্যাকেজ ৩৩ হাজার কোটি টাকার, শিল্প ও সেবা খাতের জন্য। ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ সিএমএসএমই জন্য।

প্রণোদনার এই অর্থ ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। এই দুই প্যাকেজের অর্থের অর্ধেক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জোগান দেওয়া হচ্ছে।

দুই প্যাকেজেরই ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ৪ শতাংশ পরিশোধ করবে ঋণ গ্রহীতা শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাকি ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।

শিল্প ও সেবা খাতের প্যাকেজের ৩৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ বড় উদ্যোক্তাদের বিতরণ করে ফেলেছে ব্যাংকগুলো।

কিন্তু ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণ তেমন না হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বার বার তাগাদা দেওয়া হয়েছিল ব্যাংকগুলোকে, ঋণ বিতরণের সময়সীমাও বাড়ানো হয়।

কিন্তু তাতেও প্রত্যাশিত ফল মেলেনি বলে গত ৩ ডিসেম্বর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে কোভিড-১৯ মোকাবেলা এবং টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকারের দেওয়া প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে আয়োজিত দ্বিতীয় সভায় অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার উপস্থাপিত প্রতিবেদনে দেখা যায়।

‘কর্মসৃজন ও গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সিএমএসএমই খাতের এই ঋণ বিতরণে মোটেই খুশি নয় অর্থ মন্ত্রণালয়।

“যেমনটা প্রত্যাশা করা হয়েছিল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং মাঝারি শিল্পে (সিএমএসএমই) তেমন ঋণ বিতরণ হয়নি। এমনকি, ছোট ঋণের ঝুঁকির দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংক নেওয়ার পরও এ খাতের ঋণ বিতরণ বাড়েনি। এটা খুবই দুঃখজনক।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫৬ হাজার ৮০০ ছোট উদ্যোক্তা ২০ হাজার কোটি টাকার এই তহবিল থেকে ঋণ পেয়েছেন। এর বাইরে ছোট উদ্যোক্তাদের অন্য পাঁচটি প্যাকেজের ঋণ বিতরণের চিত্র হতাশাজনক। কোনো কোনো প্যাকেজের একশ-দেড়শ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র।

এই ছয়টি প্যাকেজ কর্মসৃজন ও গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলো হচ্ছে পাঁচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার কর্মসূচি, ৫ হাজার কোটি টাকার কৃষি পুনঃ অর্থায়ন কর্মসূচি, ৩ হাজার কোটি টাকার কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পুনঃ অর্থায়ন কর্মসূচি, ১ হাজার ২৫৭ কোটি টাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সরাসরি নগদ সহায়তা কর্মসূচি, সিএমএসএমই খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার চলতি মূলধন ঋণ। এছাড়া রয়েছে সিএমএসএমই খাতের জন্য ২ হাজার কোটি টাকার ঋণঝুঁকি কর্মসূচি।

ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ না পাওয়ার জন্য এফবিসিসিআই সভাপতি থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বারবারই ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে দেশের ৬০ লাখ অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, যারা নানা ধরনের ব্যবসা করে পেট চালাতেন, তারা এখন পুঁজি ভেঙে চলছেন। অনেকে নিঃস্ব হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সত্যিই খুব খারাপ অবস্থা।”

মহামারীর ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা এই শ্রেণির হাতে আসেনি জানিয়ে তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলো ব্যস্ত বড় বড় ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের নিয়ে, যারা লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আটকে রেখেছে, ফেরত দিচ্ছে না, খেলাপি হয়ে আছে।”

দেশের অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফেরাতে চাইলে ছোট ব্যবসায়ীদের প্রতিও নজর দেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেন তিনি।

“অতি ক্ষুদ্র ব্যবসা ঘুরে না দাঁড়ালে, ছোট-মাঝারি ব্যবসা সচল না হলে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হবে না। তাই সবার আগে এদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংক ছোট ঋণের ঝুঁকির দায়িত্ব নেওয়ার পরও ব্যাংকগুলো এ খাতে ঋণ বিতরণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নানা অজুহাতে ব্যাংকগুলো ছোট ঋণ বিতরণে আগ্রহ দেখায় না। অথচ এই ঋণ খেলাপি হওয়ার নজির খুবই কম। তারপরও ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে কেন ঋণ দিতে চায় না বুঝতে পারি না। আমি মনে করি, শুধু বড় বড় উদ্যোক্তা নয়; সবার পাশেই ব্যাংকগুলোর দাঁড়ানো উচিৎ।”

২০০৭-৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এনিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বড় ব্যবসায়ীদের এক ব্যবসার ক্ষতি অন্য ব্যবসা দিয়ে পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে, যেটা ছোট ব্যবসায়ীদের থাকে না।

“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আমরা বড় বড় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের দিকেই বেশি মনোযোগ দেখছি, ছোটদের অবহেলা করছি। এই আট-নয় মাসে অতি ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা পুঁজি ভেঙে সংসারের খরচ মিটিয়েছেন। সরকারের সহায়তা ছাড়া এরা আর দাঁড়াতে পারবেন না। অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবেন না। তাই এদের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং দ্রুত সেই কাজটি করতে হবে।”

এদিকে ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণ না হওয়ায় অনাগ্রহের অভিযোগ নাকচ করেছেন রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চাহিদা বিবেচনায় ব্যাংকগুলো প্রথমে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতার অর্থ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে বড় শিল্পে ঋণ দেওয়া হয়েছে।

“এখন ছোট ঋণ বিতরণেও গতি এসেছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই ছোট ঋণ বিতরণেও আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হবে।”

ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোকে আগ্রহী করতে খেলাপি করার সময় বাড়ানো, প্রভিশন কমানোসহ নানা ছাড় দেওয়া হয়েছে। এসবের পাশাপাশি ২ হাজার কোটি টাকার ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম করা হয়েছে। এ স্কিমের আওতায় সিএমএসএমই খাতের প্রণোদনার ঋণ কোনো কারণে খেলাপি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা দিয়ে দেবে।

সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণের সময়সীমা ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর। আশানুরূপ বিতরণ না হওয়ায় পরে তা বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে।

এসবের ফলে ছোট ঋণ বিতরণে গতি আরও বাড়বে বলে আশা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছোট ঋণ বিতরণ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বার বার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। সব ব্যাংকে আলাদা ডেস্ক করতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে। আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যে সিংহভাগ ঋণ বিতরণ হবে।”