কম দামি পোশাক বাড়াল রপ্তানি আয়

মহামারীর মধ্যে বড়দিনকে ঘিরে পোশাক রপ্তানির পালে হাওয়া লাগবে বলে আশায় ছিলেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Dec 2020, 01:19 PM
Updated : 3 Dec 2020, 01:19 PM

ইউরোপ-আমেরিকায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সেই আশায় বাধ সাধলেও এর মধ্যেই কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে রপ্তানি বাণিজ্য, আর হয়েছে নিট পোশাকে ভর করে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বৃহস্পতিবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, অক্টোবরে ধাক্কার পর নভেম্বরে ফের প্রবৃদ্ধিতে ফিরেছে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক রপ্তানি আয়।

আর চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ যে আয় করেছে, তার ৪৫ শতাংশই এসেছে নিট পোশাক থেকে।

মহামারীকালে অতি প্রয়োজনীয় কম দামের পোশাক বিশেষ করে নিট পোশাক রপ্তানি বাড়ায় কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছেন রপ্তানিকারকরা।

তবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন করে ‘লকডাউন’ তাদের শঙ্কিতও করছে।

সবমিলিয়ে আগামী কয়েক মাস খারাপই যাবে বলে মনে করেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ।

তবে অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, এই দুঃসময়ে সামান্য হলেও প্রবৃদ্ধি হওয়াটাই আশার কথা।

করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় গত এপ্রিলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় তলানিতে ঠেকেছিল; ওই মাসে সবিমিলিয়ে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল মাত্র ৩৬ কোটি ডলার।

বিধি-নিষেধ শিথিলে কারখানা খোলার পর মে মাসে রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়ে, জুনে তার চেয়ে অনেক বাড়ে।

এরপর চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেও সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল। প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ওই তিন মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আয় দেশে আসে।

কিন্তু অক্টোবরে আবার হোঁচট লাগে রপ্তানি আয়ে। নভেম্বরে এসে আবার প্রবৃদ্ধির মুখ দেখল।

সদ্য শেষ হওয়া নভেম্বর মাসে ৩০৭ কোটি ৮৯ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি।

তবে নভেম্বর মাসে লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ৮ দশমিক ২ তাংশ। এই মাসে লক্ষ্য ধরা ছিল ৩৩৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। গত বছরের নভেম্বরে আয় হয়েছিল ৩০৫ কোটি ৫৮ লাখ ডলার।

গত অক্টোবর মাসে গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছিল ৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।

সবমিলিয়ে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এক হাজার ৫৯২ কোটি ৩৫ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১ শতাংশ বেশি।

২০১৯-২০ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে এক হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ।

তবে এই পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। গত বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে এক হাজার ৬১৫ কোটি ডলার আয় হয়েছিল।

রপ্তানি আয়ের পাঁচ মাসের চিত্র বিশ্লেষণ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কিন্তু একটা বিষয় সব সময় মনে রাখতে হবে। আর সেটা হলো-গত অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছিল ১৭ শতাংশ। তখন কিন্তু কোভিড-১৯ ছিল না।

“বর্তমানে মহামারীর এই কঠিন সময়ে প্রবৃদ্ধি হওয়াটাকেই আমি অনেক বড় অর্জন বলে মনে করি। পাঁচ মাসে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এই মহামারীর সময় প্রবৃদ্ধি থাকাটাও একটা বড় বিষয়।”

পোশাক রপ্তানিকারক আনোয়ার-উল আলম পারভেজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম, ২৫ ডিসেম্বরের বড়দিনকে সামনে রেখে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াব। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ শুরু হওয়ার পর আমাদের সব হিসাবনিকাশ ওলোটপালট করে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশে নতুন করে লকডাউন শুরু হয়েছে।

“জুলাই, আগাস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বায়াররা যেভাবে পোশাক কিনছিল; এখন আর কিনছে না। নতুন অর্ডারও তেমন দিচ্ছে না। এখন কম দামি পোশাক রপ্তানি করছি আমরা। বায়াররা অতি প্রয়োজনীয়, যেগুলো না হলেই নয়, তেমন পোশাক কিনছেন। সে কারণে কিন্তু নিট পোশাকের রপ্তানি বাড়ছে। আর উভেনের কমছে।”

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও একই কথা বলেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নভেম্বরে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা কিন্তু নিট পোশাকের উপর ভর করেই হয়েছে।”

এখন টিকার দকে তাকিয়ে থাকার কথা জানিয়ে হাতেম বলেন, “করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দ্রুতই চলে আসছে বলে মনে হচ্ছে। টিকা আসছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে সবাই আশা করছে। আমরাও সেই আশায় আছি।”

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রপ্তনি করে বাংলাদেশ যে এক হাজার ৫৯২ কোটি ৩৫ লাখ (১৫.৯২ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে, তার ৮১ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে।

এই পাঁচ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে এক হাজার ২৮৯ কোটি ৪৫ লাখ (১২.৮৯ বিলিয়ন) ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ৪৮ শতাংশ কম।

তবে নিট পোশাক রপ্তানিতে উল্লম্ফন হয়েছে। মোট পণ্য রপ্তানির ৪৫ শতাংশই এসেছে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে।

এই পাঁচ মাসে ৭১৩ কোটি ৬৩ লাখ (৭.১৩ বিলিয়ন) ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা লক্ষ্যের চেয়ে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ বেশি।

জুলাই-নভেম্বর সময়ে নিট পোশাক রপ্তানির লক্ষ্য ছিল ৬৮০ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৬৫৭ কোটি ৮১ লাখ ডলার।

এই পাঁচ মাসে উভেন পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৫৭৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম।

পাট রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ৩৭ শতাংশ

এই সঙ্কটেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির বড় প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।

জুলাই-নভেম্বর সময়ে ৫৫ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ২০ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় করেছে, যা ছিল আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।

অন্যান্য পণ্য রপ্তানি

মহামারীকালে ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। কৃষি পণ্য রপ্তানি বেড়েছে দশমিক ২৫ শতাংশ। হ্যান্ডিক্রাফট রপ্তানি বেড়েছে ৪৭ শতাংশের বেশি।

তবে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি কমেছে ২ দশমিক ১২ শতাংশ।

হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে ১ দশমিক ১২ শতাংশ।

করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে চলতি অর্থবছরে ৪৮ বিলিয়ন (৪ হাজার ৮০০) মার্কিন ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে সরকার, যা গত অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করে, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে আয় কম ছিল ২৬ শতাংশ।

আরও পড়ুন