এসএমই অর্থায়নে আরও উদ্যোগ প্রয়োজন: আহসান মনসুর

কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধিতে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান তুলে ধরে এই খাতে বিনিয়োগে আরও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ প্রত্যাশা করেছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Nov 2020, 10:10 AM
Updated : 24 Nov 2020, 10:10 AM

এসএমই খাতকে সবসময় ঋণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হলেও অন্যান্য শিল্পের তুলনায় এই খাত থেকে ব্যাংকঋণ খুব সফলভাবে ফিরে আসছে বলেও জানান তিনি।

মঙ্গলবার এক ওয়েবিনারে এসএমই খাতে ঋণ সহায়তা ও কর্মসংস্থানে এসএমই খাতের অবদান নিয়ে এক জরিপ প্রতিবেদন উপস্থান শেষে তিনি এই মন্তব্য করেন।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট এক হাজার প্রতিষ্ঠানের ওপর গবেষণা চালিয়েছিল ২০১৯ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার ও আহসান এইচ মনসুর এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন। জরিপ চালানো হয় আইডিএলসির ঋণ গ্রহীতাদের ওপর।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আইডিএলসির এই জরিপ কেবল আইডিএলসি নয়, সমগ্র অর্থনীতি বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জরিপে দেখা গেল এসএমই খাতে জব ক্রিয়েশন ভালো, গ্রোথ রেট ভালো এবং ঋণ পরিশোধের হার ভালো। তাই এসএমই খাতের অর্থায়নের দিকে আরও বেশি নজর দিতে হবে। 

“এই খাতে বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জটা বোঝা যায় যখন দেখা যায়, ৯২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান নিজেদের অর্থ দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছে। মাত্র এক থেকে দেড় শতাংশ প্রতিষ্ঠান শুরুতেই বিনিয়োগ পেয়েছিল। এটা নিয়ে পলিসি মেকারকে ভাবতে হবে। একজন উদ্যোক্তাকে সব সময় নিজের টাকা দিয়ে শুরু করতে হবে ব্যাপারটি তা নয়। এর উল্টো চিত্রটা দেখতে পারলে খুশি হতাম।”

এসএমইখাতের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, “আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৯৯ শতাংশই এসএমই খাতের। কাজেই এদেরকে বাদ দিয়ে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও অর্থনীতি চিন্তা করা সম্ভব নয়। এই খাত থেকেই দুই কোটির ওপরে কর্মসংস্থান হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে কৃষির পরেই এসএমইর অবস্থান। ওই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটা অনেক বড় একটা খাত।”

২০১৯ সালে আইডিএলসি ১৪ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছিল। এর মধ্যে ১০০০ প্রতিষ্ঠানের ওপরে জরিপটি চালিয়েছে পিআরআই ও আডিএলসি।

জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করে অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানে গড় বিনিয়োগ ছিল তিন কোটি টাকার মতো। বার্ষিক টার্নওভার ছিল প্রায় ছয় কোটি টাকা। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০, ২০০৬ কিংবা ২০১৬ সালের মধ্যে এরা ব্যবসা শুরু করেছিল। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণের জন্যই অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান আইডিএলসির ঋণ নিয়েছিল।

জরিপে দেখা যায়, ঋণ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১০৫ দশমিক ৭ শতাংশ কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০০০ সালে শুরু করা প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৩৭ শতাংশ। তাদের বার্ষিক গড় কর্মসংস্থান ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। সেবাখাতের প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৭৪ শতাংশ, শিল্পে ১৩১ শতাংশ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ৭৪ শতাংশ, কৃষিভিত্তিক ব্যবসায় হয়েছে ৩০ শতাংশ। 

বেতনভূক্ত কর্মচারীর কর্মসংস্থান বেড়েছে ১৩৪ শতাংশ, দিন মজুরের কর্মসংস্থান হয়েছে ৯৪ শতাংশ, পারিবারিক শ্রমের কর্মসংস্থান হয়েছে ৪৬ শতাংশ।

বাংলাদেশে জাতীয় কর্মসংস্থানের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি মাত্র ২ শতাংশ।

বজলুল হক বলেন, বাংলাদেশে শিল্প মূল্য সংযোজনের ক্ষেত্রে এসএমই খাতের ভূমিকা প্রায় ৪৫ শতাংশ। শিল্পে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এই খাতের ভূমিকা ৯০ শতাংশ এবং জাতীয় কর্মসংস্থানে ২৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক চিত্রও প্রায় একই ধরনের। ২০১৪-১৫ সালে আইএলওর এক গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বে ৪/৫কোটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর ৪৬ শতাংশ আছে পূর্ব এশিয়াতে। দক্ষিণ এশিয়ায় এই শিল্পের অংশগ্রহণ ২২ শতাংশ। বৈশ্বয়িক জিডিপিতে এই খাতের ভূমিকা প্রায় ৬০ শতাংশ, কর্মসংস্থানে ভূমিকা ৫০ শতাংশ।

“এর অর্থ হচ্ছে ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসার ঘটলে জাতীয় কর্মসংস্থান ও শিল্পায়নে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে।”

আইডিএলসির সিইও আরিফ খান বলেন, “১৫ বছর আগে এসএমই ফাইন্যান্সিং শুরু করেছিল আইডিএলসি। তার আগে কেবল লার্জ করপোরেট লেবেলে লোন দিত আইডিএলসি। করপোরেট খাত থেকে ক্ষুদ্র ঋণে যুক্ত হওয়াটা আইডিএলসির জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এসএমই ফাইন্যান্সিংকে নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হতো। আমরা তবুও একটা ছোট্ট টিম নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। ১৫ বছর পর দেখা যাচ্ছে আইডিএলসির ৪৬ শতাংশ ঋণই যাচ্ছে অনু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে।

“বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে নানপারফরমিং লোন (এনপিএল) বা অলস/খারাপ ঋণের পরিমাণ ১০ শতাংশ। কিন্তু আইডিএলসির এনপিএল রয়েছে তিন শতাংশের মধ্যে। তাহলে আমাদের দুশ্চিন্তাটি আর থাকল না। সঠিক নিয়মে কাজ করে যেতে পারলে এসএমই ফাইন্যান্সের একটা বিরাট ভবিষ্যৎ আছে বলেই মনে করি।”

গবেষণায় দেখা গেছে- সার্বিক শিল্পের শ্রমশক্তির মধ্যে ৭০ শতাংশ যুক্ত আছে ক্ষুদ্র শিল্পে। আর আইডিএলসি যখন শুরু করেছিল সেই সময় থেকে প্রায় ১৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রয়েছে তাদের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মসংস্থানে।

ওয়েবিনারের সঞ্চালক অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, “আমাদের দেশে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিল্পায়নে যেসব বাধা রয়েছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে তেমনটি নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে এসএমই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অনু, ক্ষুদ্র ও মধ্যম আকারের শিল্পে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ।

“সেই প্রেক্ষিতে আজকের গবেষণায় দেখা যায় আইডিএলসি ফাইন্যান্সিং বহু বছর ধরে কাজ করছে। তাদের ঋণ পোর্টপোলিওর ৪৫ শতাংশই এমএসএমই খাতে দিয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে ১৩৯৩১টি প্রতিষ্ঠান তাদের কাছ থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়েছে,” বলেন বিদিশা।