স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে মেট্রোরেল চালাতে ‘দিন-রাত’ কাজ

মহামারীর মধ্যেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে দিনরাত কাজ চালিয়ে মেয়াদের তিন বছর আগে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে দেশের প্রথম মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শেষ করার নতুন লক্ষ্য নিয়েছে সরকার।

জাফর আহমেদ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Nov 2020, 06:10 PM
Updated : 7 Jan 2022, 09:34 AM

এমআরটি-৬ নামের মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও ১১ দশমিক ২৯ কিলোমিটার অংশ পর্যন্ত ২০২১ সাল ও আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য ছিল।

কিন্তু এখন নতুন লক্ষ্য অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যেই পুরো মেট্রোরেল দৃশ্যমান হতে পারে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, নতুন লক্ষ্য অনুযায়ী কোভিড-১৯ এর কারণে প্রকল্পটির যেসব বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক নিজ নিজ দেশে গিয়ে আটকা পড়েছেন, তাদের বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে ঢাকায় আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্প এলাকায় কাজে ফিরেছেন প্রায় ৬০ শতাংশ বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক, যাদের বেশিরভাগ জাপানি।

তাদের জন্য এর মধ্যে প্রকল্প এলাকায় কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল চালু করার কথা তুলে ধরেন তিনি।

সিদ্দিক বলেন, “মেট্রোরেলের কাজ আগামী বছরের মধ্যে শেষ করতে এখন থেকে ইতিমধ্যেই আমরা রাত দিন ২৪ ঘণ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিশেষ করে রাতের বেলায় কাজ এগিয়ে নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একইসঙ্গে দিনের বেলায়ও যথারীতি প্রকল্পের কাজ চলমান থাকবে।”

২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। উত্তরা থেকে শুরু হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই উড়াল রেলসেতু ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ করার মেয়াদ ছিল। কিন্তু অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পটির সার্বিক গড় অগ্রগতি ৫২ দশমিক ২৪ শতাংশ।

সরেজমিনে দেখা যায়, উত্তরা দিয়াবাড়ি এলাকার উত্তরা সেন্টার ও দক্ষিণ স্টেশন দুটির ছাদ পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ওই স্টেশন দুটির শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে; শ্রমিক প্রকৌশলী সবাই আপন কাজে ব্যস্ত।

কাজের গতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকৌশলী সামসুজ্জামান সাকলাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মহামারীর কারণে গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে কাজের গতি কমে গিয়েছিল। সম্প্রতি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ লোকবল বৃদ্ধি, হাসপাতাল ও আইসোলেশনের ব্যবস্থা এবং ২৪ ঘণ্টা কাজ চালিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়ায় গতি বেড়েছে।

“২০২১ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত রেললাইনের ভায়াডাক্ট বসানোর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।”

আগারগাঁও স্টেশনের ছাদ নির্মাণের ঢালাইয়ের কাজ চলছে। ফার্মগেট এলাকায় সারি সারি পিয়ারের ক্যাপ বসানোর কাজ চলছে।

তবে এক বছরের মধ্যে পুরো প্রকল্প শেষ করার বিষয়ে সংশয় দেখা গেল প্রকল্পের ৫ম প্যাকেজের সাইট ইঞ্জিনিয়ার রিপন মাহমুদের কথায়।

তিনি বলেন, “মেয়াদের একটু এদিকে ওদিক হতে পারে অর্থাৎ হয়ত ছয় মাস বেশি সময়ও লাগতে পারে।”   

আটটি প্যাকেজে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির অক্টোবর পর্যন্ত সর্বশেষ বাস্তবায়ন অগ্রগতি তুলে ধরা হল।

প্যাকেজ-১ (ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়ন): ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাজ শুরুর পর নির্ধারিত সময়ের প্রায় নয় মাস আগে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারিতে শেষ হয়।

প্যাকেজ ২ (ডিপো এলাকার পূর্ত কাজ): ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয়ে ডিপো এলাকার পূর্ত কাজের ৭৪ শতাংশ শেষ হয়েছে।

প্যাকেজ ৩ ও ৪ (উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও নয়টি স্টেশন নির্মাণ): দুই প্যাকেজের আওতায় ৬ দশমিক ২৭ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট রেললাইন স্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে হস্তান্তর করা হয়েছে। ২০১৭ সালের অগাস্টে কাজ শুরুর পর এই প্যাকেজের বাস্তব অগ্রগতি প্রায় ৭৫ শতাংশ।

৩৯৩টি পিয়ার হেডের মধ্যে ৩৯২টি পিয়ার হেড এবং ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্টের মধ্যে ১০ দশমিক ৯৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট দৃশ্যমান হয়েছে।

নয়টি স্টেশনের সাব-স্ট্রাকচার নির্মাণ শেষ হয়েছে। উত্তরা সেন্টার ও দক্ষিণ স্টেশন দুটির ছাদ পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। উত্তরা উত্তর, পল্লবী কাজিপাড়া ও শেওড়াপাড়া স্টেশনের ছাদ নির্মাণের কাজ চলছে।

ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্প। ফাইল ছবি

উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। উত্তরা উত্তর ও উত্তরা সেন্টার স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ কাজ চলছে। উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের স্টিল কাঠামোর কাজ চলছে।

উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের মেকানিক্যাল, ইলেক্ট্রিক্যাল ও প্লাম্বিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে।

উত্তরা উত্তর উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশন ৭ নম্বর প্যাকেজ হস্তান্তরের জন্য বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, সিগন্যালিং ও টেলিকম্যুনিকেশন এবং স্টেশন কন্ট্রোলার কক্ষ নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে।

প্যাকেজ ৫ (আগারগাঁও থেকে কাওরানবাজার পর্যন্ত ৩ দশমিক ১৯ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৩টি স্টেশন নির্মাণ): ২০১৮ সালের অগাস্টে শুরু হওয়া এই প্যাকেজের আওতায় পরিষেবা স্থানান্তর চেকবোরিং ট্রায়াল ট্রেঞ্চ টেস্ট পাইল ও স্থায়ী বোর্ড পাইলিং শেষ হয়েছে।

এ প্যাকেজের আওতায় মোট ১০৬টি পিয়ার কলামের মধ্যে ১০২টি পিয়ার কলাম শেষ হয়েছে। ২০৩টি পাইল ক্যাপের মধ্যে মেইন লাইনের পাইল ক্যাপের ১০৬টি এবং স্টেশনের ৯৭টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ২২টির কাজ শেষ হয়েছে। এই প্যাকেজে মোট ১২৮টি পাইল ক্যাপ সম্পন্ন হয়েছে।

বর্তমানে ফার্মগেট স্টেশনের সাবট্রাকচার নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। এই প্যাকেজের মোট ১১৫টি স্টেশন কলামের মধ্যে ১৯টি কলামের কাজ শেষ হয়েছে। ৯০টি পিয়ার হেডের মধ্যে ৬৫টি পিয়ার হেড এবং এক হাজার ৪৮টি প্রিকাস্ট সেগমেন্টের মধ্যে ২৭৭টির কাজ শেষ হয়েছে।

এই প্যাকেজের আওতায় উত্তরা ডিপো এলাকায় নির্মাণাধীন মেট্রোরেল এক্সিবিশন অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টারের পূর্ত কাজের অগ্রগতি প্রায় ৯৮ শতাংশ। প্যাকেজটি সার্বিক বাস্তব অগ্রগতি ৫০ দশমিক ১৮ শতাংশ।

প্যাকেজ ৬ (কাওরান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৪ দশমিক ৯২ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও চারটি স্টেশন নির্মাণ): ২০১৮ সালের অগাস্টে শুরু হওয়া এই প্যাকেজটির কাজ বর্তমানে পরিষেবা স্থানান্তর চেকবোরিং ট্রায়াল ট্রেঞ্চ, টেস্ট পাইল এবং সকল স্থায়ী বোর্ড পাইল, ১৬০টি পিয়ার কলামের মধ্যে ১১৪টি পিয়ার কলাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনের সাবস্ট্রাকচার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। মোট ১৩০টি স্টেশন কলামের মধ্যে সাতটি স্টেশন কলাম নির্মাণ শেষ হয়েছে।

এই অংশে মোট ২৯৮টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ১৩৭টি পাইল ক্যাপ শেষ হয়েছে। ১৩৬টি পিয়ার হেডের মধ্যে ১০০টি পিয়ার হেড সম্পন্ন হয়েছে এবং এক হাজার ৬২০টি সেগমেন্টের মধ্যে ৫০৮টি সেগমেন্ট সম্পন্ন হয়েছে। এই প্যাকেজের বাস্তব অগ্রগতি ৫১ দশমিক ১২ শতাংশ।

.

প্যাকেজ ৭ (ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল সিস্টেম): এই প্যাকেজের আওতায় বৈদ্যুতিক এবং কারিগরি সিস্টেম নির্মাণকাজ করা হচ্ছে। টঙ্গি ও মানিকনগর গ্রিড সাবস্টেশনে বে স্থাপন এবং উত্তরা ডিপোতে রিসিভিং সাবস্টেশনের পূর্ত কাজ শেষ হয়েছে। উত্তরা ডিপোতে রিসিভিং সাবস্টেশনে ভবন যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে।

মতিঝিল রিসিভিং সাবস্টেশন ভবন নির্মাণকাজ চলছে। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং রেললাইন নির্মাণের অধিকাংশ মালামাল উত্তরা ডিপোতে এসে পৌঁছেছে। ডিপো এলাকার ওয়ার্কশপ শেডের ভেতরে ১১টি রেললাইনের মধ্যে দুটি লাইনে রেলট্র্যাক শেষ হয়েছে এবং নয়টি ট্র্যাক স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে।

স্টাব্লিং শেডের ভেতরে ১৯টি রেললাইনের মধ্যে ৫টি রেললাইন স্থাপনের কাজ চলছে। উত্তরা ডিপোর ব্যালাস্টেড রেল ট্র্যাকের জন্য ওয়েল্ডিংয়ের কাজ সমাপ্ত হয়েছে।

ভায়াডাক্টের ওপর মেইন লাইনের ২ হাজার ৬৭৮টি রেল জয়েন্ট ওয়েল্ডিংয়ের মধ্যে ৮৬২টির কাজ শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যে ডিপোতে ৩ দশমিক ৯২ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন করা হয়েছে।

ডিপো এরিয়ায় রেললাইন নির্মাণ কাজের সার্বিক অগ্রগতি ২৩ শতাংশ। ভায়াডাক্টের ওপর মেইন লাইনের ২ হাজার ৬৭৮টি রেল জয়েন্ট ওয়েল্ডিংয়ের মধ্যে ১ হাজার ৯৩টি সমাপ্ত হয়েছে।

ভায়াডাক্টে ২ দশমিক ৭ কিলোমিটার সংযোগ স্থাপনের কাজও শেষ হয়েছে। এরমধ্যে ৮০০ মিটার রেল লাইন স্থাপন করা হয়েছে। এক্সিভিশন অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টারের মধ্যে প্যাসেঞ্জার গেইট স্থাপন কাজ শেষ হয়েছে।

প্রকল্পটির বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় ডেসকো সাবস্টেশন থেকে উত্তরা রিসিভিং সাবস্টেশন পযন্ত ১৩২ কেভি আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল স্থাপনের এর কাজ শেষ হয়েছে।আবার উত্তরা রিসিভিং সাবস্টেশন থেকে পিজিসিবি গ্রিড সাবস্টেশন পর্যন্ত ১৩২ কেভি আন্ডার গ্রাউন্ড ক্যাবল স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে।

এই প্যাকেজটির সিসিটিভি মনিটর, রেক্টিফায়ার্ড ট্রান্সফরমারসহ সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ডিপোতে এসে পৌঁছেছে। এই প্যাকেজের বাস্তব অগ্রগতি ৫১ শতাংশ।

প্যাকেজ ৮ (রেল কোচ ও ডিপোর সরঞ্জাম সংগ্রহ):  এই প্যাকেজের আওতায় বগি নির্মাণের কাজ জাপানে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরুর পর বাস্তব অগ্রগতি ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ।

গত বছর এপ্রিলে যাত্রীবাহী কোচ নির্মাণের কাজও জাপানে শুরু হয়েছে। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের মকআপ ট্রেন ডিপোতে পৌঁছেছে। ছয়টি যাত্রীবাহী কোচ সম্বলিত প্রথম মেট্রো ট্রেন সেট এবং দ্বিতীয় ট্রেন সেটের নির্মাণকাজ ইতিমধ্যে জাপানে শেষ হয়েছে। জাপানের একটি কারখানায় আরও তিনটি মেট্রোরেল সেট তৈরির কাজ চলছে।