রাজস্ব আদায়েও গতি ফিরছে

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর সঙ্গে রাজস্ব আদায়ও বাড়ছে।

প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Oct 2020, 08:35 PM
Updated : 28 Oct 2020, 03:35 AM

চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৪ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। পরের মাস অগাস্টে তা বেড়ে ১৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা হয়েছে।

সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে তা আরও বেড়ে ২০ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে।

সব মিলিয়ে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আদায় হয়েছে ৪৯ হাজার ৯৮৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। গত বছরের এই তিন মাসে আদায় হয়েছিল ৪৮ হাজার ১৭ কোটি ২০ লাখ টাকা।

এ হিসাবে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ১১ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে।

মহামারীকালে বড় ধাক্কা নিয়ে শুরু হয় অর্থবছর। প্রথম মাস জুলাইয়ে গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ২২ শতাংশ রাজস্ব আদায় কম হয়। দুই মাস (জুলাই-অগাস্ট) মিলিয়ে অবশ্য প্রবৃদ্ধি হয়; তবে খুবই সামান্য মাত্র দশমিক শূন্য ১৬ শতাংশ।

গত বছরের মার্চে দেশে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাব শুরুর দিকে রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছিল। তখন রাজস্ব আদায় প্রায় তলানিতে ঠেকেছিল। ওই সময়ে প্রায় সব কিছু বন্ধ থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালু রাখা হয়। তবু রাজস্ব আদায় খুব বেশি হয়নি।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫০ শতাংশের মতো রাজস্ব আদায় কমে যায়।

পরের তিন মাসে অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সেই অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।

সর্বশেষ তিন মাসের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি অর্থনীতি উঠে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক হচ্ছে রাজস্ব আদায়। গত তিন মাসে আগের চেয়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে। এটা ভালো লক্ষণ। করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।”

তবে এতে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে রাজস্ব আদায়ের গতি আরও বাড়াতে এনবিআরের ব্যাপক সংস্কারের  পরামর্শ দিয়ে আহসান মনসুর বলেন, “গত তিন মাসে ভ্যাট আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ১৯ শতাংশ। এর মানে, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙা হয়নি। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙা হতে আরও পাঁচ-ছয় মাস লাগতে পারে। তবে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।”

সাধারণত অর্থবছরের শেষ দিকে অর্থাৎ এপ্রিল, মে ও জুন মাসে রাজস্ব আদায় ভালো হয়। এই সময়ে আগের মাসগুলোর তুলনায় রাজস্ব আদায়ে গতি থাকে। লক্ষ্য অর্জনে বড় ভূমিকা রাখে এই সময়টি। কিন্তু করোনাভাইরাস এবার সেই ‘সোনালি সময়’টি খেয়ে ফেলেছিল।

সে কারণেই গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি হয়েছিল বলে মনে করেন আহসান মনসুর।

“এছাড়া লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী ধরা হয়েছিল। এবারও অবাস্তব লক্ষ্য ধরা হয়েছে।”

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত এপ্রিল-জুন সময়ে মাত্র ৫২ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা শুল্ক-কর আদায় হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে ৭০ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। সেই হিজসাবে আগের বারের চেয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে।

মূলত গত এপ্রিল-জুন সময়ে আমদানি-রপ্তানিতে গতি ছিল না; দোকানপাট বন্ধ ছিল। অর্থনীতি প্রায় থমকে দাঁড়ায়। এসব কারণে শুল্ক-কর আদায় কমে যায়।

পরের তিন মাসে দোকানপাট খুলতে শুরু করে। আমদানি-রপ্তানিও বাড়তে থাকে। ফলে রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতিও বদলে যেতে থাকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ ২০১৯ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে যত রাজস্ব আদায় হয়েছিল, ২০২০ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে তার চেয়ে প্রায় এক হাজার ৯৭২ কোটি ৫২ লাখ টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে।

এই তিন মাসে নতুন বিনিয়োগ কিংবা নতুন ব্যবসা চালু হয়নি বললেই চলে। তবু আগের বছরের চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হওয়ার মানে, অর্থনীতি উঠে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। বেচাকেনা, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হচ্ছে।

“আগের প্রান্তিকের খারাপ অবস্থা কাটিয়ে রাজস্ব খাত এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে,” বলেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।

মাসওয়ারি হিসাবে মহামারীকালে গত ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল গত এপ্রিল মাসে। ওই মাসে মোটা দাগে সব কিছুই বন্ধ ছিল। কিছু অতি প্রয়োজনীয় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। যেমন সুপারশপ, ওষুধের দোকান ইত্যাদি। বেশিরভাগ কলকারখানাও বন্ধ ছিল। আমদানি-রপ্তানি নামমাত্র সচল ছিল।

এপ্রিল মাসে মাত্র ৮ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা আদায় হয়। এটি সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যে এক মাসের হিসাবে সবচেয়ে কম রাজস্ব আদায়। মে মাসের শেষ দিকে সীমিত পরিসরে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান খোলা শুরু করে। এতে শুল্ক-কর আদায় কিছুটা বেড়ে ১৩ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা হয়। জুন মাস ছিল গত অর্থবছরের শেষ মাস। ওই মাসে অর্থনীতি খুলতে শুরু করে এবং এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের তাগিদও বাড়ে। জুন মাসে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় হয়, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।

সব মিলিয়ে পুরো অর্থবছরের আদায় দাঁড়ায় ২ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা কম। সার্বিকভাবে ৮২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হয়। এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ রাজস্ব ঘাটতির মুখে পড়ে এনবিআর।

চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকে এনবিআরের রাজস্ব আদায় অনেকটাই স্বাভাবিক হতে শুরু করে। যদিও তা লক্ষ্য অনুযায়ী হয়নি। গত জুলাই মাসে ১৪ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়। অগাস্টে তা বেড়ে ১৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা হয়। পরের মাসে রাজস্ব আদায় বাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর মাসে ১৯ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়।

গত কয়েক বছরের রাজস্ব আদায়ের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে প্রতি মাসে গড়ে ১৪ থেকে ২১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়। তবে এবার এনবিআরকে আগের বছরের চেয়ে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা বা ৫০ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে।

মঙ্গলবার এনবিআর রাজস্ব আদায়ের যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আদায়ে। এই খাত থেকে ১৮ হাজার ১১১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ১৯ শতাংশ।

আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৫ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আয়কর ও ভ্রমণ কর বাবদ প্রত্যক্ষ কর আদায় হয়েছে ১৫ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

তবে সব মিলিয়ে এই তিন মাসে লক্ষ্যের চেয়ে ১৩ হাজার ৭২৪ কোটি ৬ লাখ টাকা রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে লক্ষ্য ধরা আছে ৬৩ হাজার ৭১৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।

চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের মোট লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্য অর্জনে প্রতি মাসে গড়ে ৩১ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। অর্থাৎ আগামী ৯ মাসে  (অক্টোবর-জুন) আদায় করতে হবে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে আহসান মনসুর বলেন, “বাজেট ঘোষণার পরপরই আমরা বলেছিলাম, বিশাল এই লক্ষ্য অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তারই ধারাবাহিকতায় বলছি, লক্ষ্য পূরণ না হলেও কোনো সমস্যা নেই; মোটামুটি একটা ভালো প্রবৃদ্ধি হলেই যথেষ্ট।”

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটি কঠিন সময় পার করছি আমরা। এমন মহামারীর মুখোমুখি কখনই হয়নি। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে তাই কৌশলী হতে হবে।”

রাজস্ব আদায়ে যে গতি ফিরেছে তাতে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ এর এই কঠিন পরিস্থিতিতে যে সব খাত ভালো করছে তাদের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করতে হবে, আর যারা খারাপ করছে তাদের ছাড় দিতে হবে।”