কৃষির ক্ষতি কমাতে নজর রবি ফসলে

করোনাভাইরাস মহামারী ও চলতি বছরে কয়েক দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষির ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার আসন্ন রবি মৌসুমে কয়েকটি ‘পুনর্বাসন কর্মসূচি’ নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2020, 08:31 AM
Updated : 15 Oct 2020, 08:31 AM

বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।

মন্ত্রী বলেন, “কয়েক দফা বন্যার পর আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ হল, কৃষক যাতে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে না পড়ে সেজন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি নেওয়া। আমরা রবি ফসলে ব্যাপক পুনর্বাসন কর্মসূচি নিয়েছি।

“আমরা বলছি যে হাইব্রিড বোরো সেটার আরও অনেক বেশি বীজ বিনামূল্যে চাষীদের দেব, যাতে উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। এখন মোটা চাল ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আমরা মোটা চাল বা হাইব্রিড ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করব, যেন আগামী বোরোতে একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চালের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারি।”

কৃষি তথ্য সার্ভিস- এইআইসের তথ্য বলছে, এসএল ৮এইচ, ব্রি-হাইব্রিড ধান ১, ২, ৩, হিরা, তেজ, এসিআই-২, সাথী, লাল তীর, মধুমতি, আলোড়ন, জাগরণ, জাগরণ-৩, রূপসী বাংলা-১, রূপালী ও সচ্ছল জাতের হাইব্রিড বোরো ধানের চাষ এখন বাংলাদেশে হচ্ছে।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, বোরো ধানের বীজে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা হারে ভর্তুকি দেওয়া হবে।

“কেজিতে প্রায় ২৫ শতাংশ হলেও আমরা ভর্তুকি দেওয়ার চিন্তা করেছি। আগামী বছর হাইব্রিড বোরো চাষ করার জন্য ১০০ কোটি টাকা চেয়েছি, যাতে বিনামূল্যে চাষীদের হাইব্রিড বীজ দিতে পারি।”

বোরো মৌসুমে কৃষকের মজুরি ও ধান কাটার সরঞ্জাম কিনতেও সহযোগিতা করার কথা বলেন কৃষিমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের আওতায় আগামী বোরো মৌসুমে ধান কাটতে কম্বাইন্ড হারভেস্টার, রিপার আনবে কৃষি মন্ত্রণালয়।

এতে কৃষি শ্রমিকের মজুরি ‘সহনশীল মাত্রায় চলে আসবে’ বলে কৃষিমন্ত্রীর বিশ্বাস।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছর দুই দফা বন্যায় দেশের ৩৪ জেলায় দেড় লাখ হেক্টরের বেশি ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে।

প্রথম ধাপে ২৮টি জেলার প্লাবিত এলাকায় প্রায় ৩৪৯ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি নিরূপণ করেছিল অধিদপ্তর। আশ্বিনের শেষভাগেও দেশের কিছু কিছু এলাকায় ফের বন্যা দেখা দিয়েছে।

বন্যার পর আউশ ও আমনের উৎপাদনসহ সার্বিক পরিস্থিতি প্রতিদিন নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করে ‘প্রয়োজন হলে’ সীমিত পরিমাণে চাল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

বন্যার কারণে আউশ ও পরে আমন ধানের বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কাঙিক্ষত ফলন না আসায় চাল আমদানির চিন্তা চলছে বলে জানান আব্দুর রাজ্জাক।

“আউশের জন্য আমরা ২ লাখ হেক্টর জমি টার্গেট করেছিলাম । সেটা অর্জনও করেছিলাম। আগাম বন্যার কারণে আউশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে ঝুঁকির কারণ হল আমন। আমন নিয়েও আমাদের অনিশ্চয়তা আছে। 

“এ পরিস্থিতিতে যদি কিছু ঘাটতিও হয়… যদি আমনের বেশি ক্ষতি হয়ে যায়…, হারভেস্ট করতে না পারি, সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে কিছু চাল আনাও লাগতে পারে। সেটা আমরা এখনও কিছুই বলতে পারছি না। আমরা আরও কয়েকটা দিন দেখব। আরও ১৫-২০ দিন পরে বোঝা যাবে আমনের উৎপাদন কি হবে।”

তবে উঁচু জমিতে বোনো আমন ধানের আবাদ ‘ভালো হবে’- এমন আশায় কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, “আমি মনে করি না যে বাংলাদেশে খাদ্য নিয়ে কোনো হাহাকার হবে, যে পরিমাণ খাদ্য আছে। সরকারের যে সোশাল সেইফটিনেট প্রোগ্রাম… খাদ্য যদি ঘাটতি হয়, তাহলে কম মূল্যে, বিনামূল্যে গরীব মানুষের মধ্যে চাল বিতরণ করা হবে। সেক্ষেত্রে সরকার নীতিগত অনুমোদনও দিয়ে রেখেছে।”

আব্দুর রাজ্জাক জানান, এই অর্থবছরে চালের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৩ কোটি ৮৭ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) দাবি করেছে, নভেম্বর শেষে বাংলাদেশে চাহিদা মেটার পর সাড়ে ৫৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে।

সংবাদ সম্মেলনে আলুর দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গেও কথা বলেন কৃষিমন্ত্রী।

“তারা (ব্যবসায়ীরা) আলু কিনেছে ১৭-১৮ টাকা দরে। কিন্তু এটা তাদের ৪০-৪৫-৫০ টাকা করে কেন বেচতে হবে? এই যে লাভের লিপ্সা, ন্যূনতম নৈতিকতা তাদের মধ্যে কাজ করছে না। এক কেজি আলুতে ২০ টাকা লাভ করা কি মুখের কথা!

“আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কাজ, বাজারের চাহিদা… তাদের কারসাজির কাছে… তবে আমরা কিন্তু নীরব দর্শকের ভূমিকায় বসে নেই। আমরা মনিটর করছি। আর ২০-২৫ দিন সবজির দাম বেশি থাকবে। তারপরে নতুন সবজি এসে যাবে। তারপর দাম কমে যাবে সবজির।”

সংবাদ সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী জানান, এ বছর আউশ ও আমন ধানের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থ বছরে আবাদ হয়েছে ১৩ দশমিক ২৯৬ লাখ হেক্টরে এবং উৎপাদন হয়েছে ৩৪ দশমিক ৫ লাখ মেট্রিক টন। ফলে আউশের আবাদ প্রায় ২ লাখ হেক্টর, উৎপাদন ৪ লাখ টন বৃদ্ধি পেয়েছে। 

এ বছর রোপা ও বোনা আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৯ লাখ হেক্টর। কয়েক দফায় বীজতলা, চারা, মাঠের ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বিনামূল্যে চারা বিতরণ, ভর্তুকি সহায়তা, উদ্বুধকরণের মাধ্যমে রোপা আমনে সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। বোরো ধানে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা হারে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে।

মহামারীর এই সময়ে এবং পরে পারিবারিক পুষ্টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৩৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে দেশের ৪ হাজার ৩৯৭টি ইউনিয়নে ৩২টি করে মোট ১ লাখ ৪০ হাজার ৩৮৭টি পুষ্টি বাগান স্থাপন করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৩১ জন ক্ষতিগ্রস্থ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মধ্যে ১৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকার সার, কৃষি উপকরণ, যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হয়েছে। ৯ লাখ ২৯ হাজার ১৯৪ জন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে গম, সরিষা, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী, খেসারি, পেঁয়াজ, মরিচ ও টমেটো চাষের জন্য ৭৫ কোটি টাকার কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে বিনামূল্যে।

পৃথিবীর অনেক দেশেই ইতোমধ্যে মহামারীর কারণে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশকেও খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।

তাছাড়া ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও বাংলাদেশ রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে।

এমন চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে আগামী ১৬ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী খাদ্য দিবস ২০২০ উদযাপিত হতে যাচ্ছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করেছে ‘সবাইকে নিয়ে একসাথে বিকশিত হোন, শরীরের যত্ন নিন, সুস্থ থাকুন। আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ’। 

দিবসটি উপলক্ষে শুক্রবার সকাল ১০টায় রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে ওই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এছাড়া খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এবং কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মতিয়া চৌধুরী অংশ নেবেন সেমিনারে।

আরও পড়ুন