৫ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে ইলিশ উৎপাদন

দেশে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ৩ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ ধরা হয়েছিল, ২০১৮-১৯ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন।

কাজী মোবারক হোসেন নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Oct 2020, 05:05 AM
Updated : 10 Oct 2020, 05:05 AM

মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোতে জাটকা ধরা বন্ধ করা এবং নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ ধরা বন্ধ করার কারণে ধারাবাহিকভাবে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। শুধু তাই বেশি ওজনের ইলিশও এখন পাওয়া যাচ্ছে।

মা ইলিশ রক্ষায় সরকার প্রজনন মৌসুম চিহ্নিত করে ২২ দিন ইলিশ শিকার, আহরণ, বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও পরিবহন নিষিদ্ধ করেছে। এছাড়া আট মাস জাটকা নিধন এবং ৬৫ দিন সাগরে মাছ শিকার বন্ধ থাকছে।

দশ বছর আগে ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে দেশে উৎপাদিত ইলিশের পরিমাণ ছিল ২.৯৮ লাখ মেট্রিক টন। নানা পদক্ষেপের পর ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে ইলিশ উৎপাদন।

এবছর আগামী ১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর ২২ দিন ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্রে ইলিশসহ সব ধরনের মৎস্য আহরণ বন্ধ হচ্ছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ ব্যবস্থাপনা শাখার সহকারী পরিচালক মাসুদ আরা মমি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এসময় দেশব্যাপী ইলিশ আহরণ, বিপণন, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, বিনিময় এবং মজুতও নিষিদ্ধ থাকবে।

তিনি বলেন, সরকারের দিক থেকে এ বিষয়ে জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য উদ্দীপনামূলক প্রচারাভিযান চালানো হবে।

“নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ ধরা ঠেকাতে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি জেলেদেরও মানসিকভাবে এই কার্যক্রমে যুক্ত করে উপকূলীয় এলাকায় প্রচারকাজ চালানো হবে, যাতে জেলেরা নিজেরাই নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিরত থাকবেন।”

চট্টগ্রাম নগরীর কাট্টলী রানী রাসমনি ঘাটের জেলেরা জাল মেরামত করছেন ইলিশ ধরতে যাওয়ার আগে। ছবি: উত্তম সেন গুপ্ত

মাসুদ আরা বলেন, “বাজারে বিক্রি বন্ধ করতে আমাদের ১০টি টিম কাজ শুরু করছে।”

এতে কর্মহীন হয়ে পড়া জেলের জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কোনো সন্দেহ নেই যে এই ২২ দিন ইলিশ ধরতে না পারায় জেলেদের যথেষ্ট কষ্ট সহ্য করতে হবে।

“এই জন্য ৩৬টি জেলার ১৫২টি উপজেলায় মা ইলিশ আহরণে বিরত থাকা ৫ লক্ষ ২৮ হাজার ৩৪২টি জেলে পরিবারের জন্য ২০ কেজি হারে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম শুরুর পূর্বেই এ বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। এ মৌসুমে গত মৌসুমের তুলনায় অতিরিক্ত ১ লক্ষ ২০ হাজার ২৬৩টি জেলে পরিবারকে এ খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।”

এ বিষয়ে মৎস্য বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, “এক সময় ১১ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ ছিল, পরে ১৫ দিন বন্ধ ছিল, এখন ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ।

“আসলে ইলিশ সারা বছরিই ডিম দেয়। তবে এই ২২ দিন ৬০-৭০ ভাগ ইলিশ ডিম দেয়। যার কারণে উপযুক্ত সময় হিসেবে এই ২২ দিনকে ধরা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এই ২২ দিন ঠিক আছে।”

মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, মা ইলিশ রক্ষা করার কারণে গত কয়েক বছরে উৎপাদন যেমন বেড়েছে, দামও কমে এসে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে এসেছে। এছাড়া সাগর ও নদ-নদীতে ধরা পড়া ইলিশের গড় ওজন গত তিন বছরে ৩৫০ গ্রাম বেড়েছে।

ঢাকার কারওয়ান বাজারের পাইকারি আড়তে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকায়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

বহির্বিশ্বে রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় দেশে ইলিশের চাহিদা পূরণও হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন মৎস্য কর্মকর্তারা।

মাসুদ আরা বলেন, “দেশে ইলিশের চাহিদা মেটানোর জন্য ২০১২ সালের ২ জুলাই আমরা ইলিশ রপ্তানি বন্ধ রেখেছি। তবে দীর্ঘদিন পরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কারণে ভারতে কিছু ইলিশ দেওয়া হয়, সেটাও একেবারেই নগণ্য।”

গত বছর ভারতে ৫০০ মেট্রিক টন এবং এ বছর ১৪শ মেট্রিক ইলিশ রপ্তানি হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, এর বাইরে আর কোথাও রপ্তানি হয়নি।

স্বাদের তারতম্য

পানি ভেদে ইলিশ মাছের স্বাদে তারতম্যের বিষয়ে মাসুদ আরা বলেন, ইলিশের স্বাদ মূলত নির্ভর করে মাছটা পরিপক্ক হয়েছে কি না। পরিপক্ক ইলিশ যেখানেই থাকুক স্বাদ বেশি হবেই।

“তবে পানি ভেদে স্বাদ কিছুটা বেশি হয়, কারণ লবণাক্ত পানি থেকে মিঠা পানিতে যখন ইলিশ আসে, তখন তার খাদ্যাভাস পরিবর্তন হয়। মিঠাপানির খাবারে কিছুটা ফ্যাট থাকে, চর্বি থাকে যার কারণে স্বাদ বাড়ে। জুলাই থেকে অক্টোবরে ইলিশ মিঠা পানিতে আসে, সে সময় স্বাদ বেশি হয়।”

অধ্যাপক মনিরুল বলেন, স্বাদের তারতম্য নির্ভর করে পানির বৈশিষ্ট্যের উপর।

সাগর থেকে নৌকাভরে ইলিশ নিয়ে ফিরছে জেলেরা। ছবি: সুমন বাবু

“মিঠা পানি বা স্বাদু পানিতে উদ্ভিদ কণা বেশি থাকে, যার কারণে স্বাদের তারতম্য হয়। যে এলাকার পানি নোনা সেখানে উদ্ভিদ কণার উপস্থিতি একেবারেই কম, যার কারণে স্বাদের তারতম্য হয়।”

পানি ভেদে ইলিশের স্বাদের তারতম্যের কারণ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মো, নিজামুল হক ভূইয়া বলেন, “চাঁদপুর, বরিশাল, পদ্মা, নাফ নদী সারা দেশের ইলিশের স্বাদ এক এক জায়গার একেক রকম। এর কারণ হচ্ছে পানিতে প্রোটিনের পরিমাণ। এছাড়া একেক জায়গার পনির মাছ একেক রকম তৈলাক্ত হয়।”

স্বাদের তারতম্য থাকলেও মাছের পুষ্টিগুণের কোনো তারতম্য হয় না বলে জানান তিনি।