পাটের দামে কৃষক খুশি, রপ্তানিও বেশি

করোনাভাইরাস সঙ্কটের সময়ে পাটের বেশি দাম পেয়ে খুবই খুশি পাবনার চাটমোহর উপজেলার কুমারগাড়া গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Oct 2020, 04:17 PM
Updated : 6 Oct 2020, 04:17 PM

এবার সাত বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলেন তিনি, ৫০ মণের মতো পাট পেয়েছেন।

সাইফুল সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টাকার দরকার থাকায় মাস খানেক আগে ২৬০০ টাকায় বেচে দিয়েছি। এর আগে কখনই এত দামে পাট বেচিনি।”

বাংলাদেশের হাট-বাজারে এখন প্রতি মণ ভালো মানের পাট তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মন্দ মানের পাটের দরও আড়াই হাজার টাকার উপরে। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এত দামে পাট বিক্রি হয়নি।

সাইফুল বলেন, “দাম এখন তিন হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে। কিন্তু আমার আক্ষেপ নাই। এই খারাপ সময়ে ২৬০০ টাকায় যে বেচতে পেরেছি, তাতেই খুশি আমি।”

সাইফুলের মতো অনেক কৃষক এবার দাম বেশি পাওয়ায় আগামী মৌসুমে আরও বেশি জমিতে পাট চাষ করার পরিকল্পনা করছেন তারা।

শুধু দামে নয়; পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানির পালেও বইছে সুবাতাস। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেও বেড়েই চলেছে এই খাতের রপ্তানি।

তবে কাঁচা পাটের দাম ‘অস্বাভাবিক’ বেড়ে যাওয়ায় খুশি নয় বেসরকারি পাটকল মালিকরা। তারা বলছেন, এত বেশি দামে পাট কিনে পণ্য উৎপাদন করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।

ফরিদপুরের ভাঙ্গায় পাটের আঁশ ধোয়ায় ব্যস্ত কৃষকরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সাড়ে সাত থেকে আট লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। যেখানে কম বেশি ৮০ লাখ বেল পাটের আঁশ উৎপন্ন হয়ে থাকে।

দেশের সব জেলাতেই কম-বেশি পাটের চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি পাটের চাষ হয় ফরিদপুর জেলায়, সেখানে এবার ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। গত মৌসুমে হয়েছিল ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে।

পাটনির্ভর এই জেলায় ১৯টি পাটকল আছে; সবগুলোই বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে সচল রয়েছে ১৩টি।

দেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি খাতের জুট মিল করিম জুট মিল এই ফরিদপুরেই অবস্থিত। পারটেক্স গ্রুপের পারটেক্স জুট মিলও এই জেলাতেই অবস্থিত।

ফরিদপুরের জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হযরত আলী সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবারের পাট মৌসুম শেষ হয়েছে বলা যায়। কৃষক তাদের পাট ঘরে তুলেছেন। যাদের টাকার খুব প্রয়োজন বিক্রি করে দিচ্ছেন। অনেকে বেশি দামের আশায় মজুদ করে রাখছেন।

তিনি জানান, ফরিদপুরের বিভিন্ন হাটে এখন ভালো মানের প্রতি মণ পাট ২ হাজার ৯০০ থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নিম্ন মানের পাটও বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ থেকে ২৬০০ টাকায়।

“এবার দাম বেশি পাওয়ায় পাট চাষিরা খুবই খুশি। আগামী মৌসুমে আরও বেশি জমিতে পাটের চাষ করতে এখনও আমাদের কাছে পরামর্শ নিতে আসছেন অনেকে।”

মানিকগঞ্জের সাতটি উপজেলার সব জায়গা থেকেই চাষীরা ঘিওরের হাটে আসেন তাদের উৎপাদিত পাট বিক্রি করতে।

মানিকগঞ্জে জেলায় এবার ৩৬ হাজার ১৬ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী উপ-পরিচালক আব্দুল কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাটের দাম বেশি পাওয়ায় এই করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেও ফুরফুরে মেজাজে আছেন কৃষকরা।

“সবাই আশঙ্কা করেছিল, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবার পাটের দাম পাওয়া যাবে না। কিন্তু হয়েছে তার উল্টোটা।”

এই জেলার ঘিওর উপজেলার কৃষক শহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাটের এত বেশি দাম আমি আমার জীবনে আগে কখনই দেখিনি। কষ্ট করে পণ্য ফলায়ে ভালো দাম পাওয়া গেলে খুশিই লাগে।”

কৃষক পাটের বেশি দাম পাওয়ায় তা ইতিবাচক মনে করছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের পাটের রপ্তানি বাজার বরাবরই ভালো ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল আদমজী বন্ধসহ একটার পর একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা সেই বাজার ধরতে পারিনি।

“এখন মহামারীর কারণে পাট ও পাট পণ্য রপ্তানির যে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, সেটা আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারব সেটাই এখন বড় বিষয়।”

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক আসাদুজ্জামান বলেন, “এমন যেন না হয়, এবার কৃষক ভালো দাম পেয়েছে, সে আশায় আগামী মৌসুমে আরও বেশি উৎপন্ন করল। কিন্তু দাম না পেয়ে হতাশ হল। পরের মৌসুমে উৎপাদন কমিয়ে দিল।”

সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, বর্তমানে দেশে পাটচাষির সংখ্যা ৪০ লাখ। দেশের জিডিপিতে পাট খাতের অবদান দশমিক ২৬ শতাংশ ও কৃষি জিডিপিতে তা ১ দশমিক ৪ শতাংশ।

খুশি নন পাটকল মালিকরা

বেসরকারি পাটকল মালিকরা বলছেন, এত বেশি দামে পাট কিনে পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি বাজার ধরে রাখা সম্ভব হবে না।

বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান জাহিদ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টাকা দিয়েও আমরা এখন পাট পাচ্ছি না। সবাই আরও বেশি দামের আশায় পাট আটকে রেখেছে।

“কৃষক থেকে শুরু করে পাট ব্যবসায়ী-সবাই পাট মজুদ করে রেখেছে। মসজিদের ঈমাম-স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা পাট কিনে মজুদ করে রেখেছেন লাভের আশায়। আমি আমার জীবনে পাট নিয়ে এমন অস্থিতিশীল অবস্থা আগে কখনই দেখিনি।”

ফাইল ছবি

করিম জুট মিলসের মালিক জাহিদ বলেন, “এ কথা ঠিক যে, এই মহামারীর মধ্যেও পাট ও পাট পণ্য রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু একটা বিষয় সবাইকে মনে রাখতে হবে। আর সেটি হচ্ছে, অনেক বেশি দামে কাঁচাপাট কিনে পণ্য উৎপন্ন করে সেই পণ্য আমাদের রপ্তানি করতে হচ্ছে। এতে আমাদের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু রপ্তানি পণ্যের দাম কিন্তু বাড়েনি।

“এতে আমাদের অনেক মিলের লোকসান হচ্ছে। আর লোকসান দিয়ে তো মিল চালু রাখা সম্ভব নয়।”

সে কারণেই গত ১৮ সেপ্টেম্বর সরাসরি কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ, ২০১৪ সালের মজুদ আইনের যথাযথ বাস্তবায়সহ বেশ কিছু বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে চিঠি দিয়েছেন বেসরকারি পাটকল মালিকরা।

“আশা করছি, খুব শিগগিরই একটা ইতিবাচক ফল পাব আমরা,” বলেন জাহিদ।

গত জুলাই মাসে সরকার বিজেএমসির আওতাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলে উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়ায় পাট রপ্তানি এখন বেসরকারি খাতনির্ভর। সরকারি পাটকলগুলোতে উৎপাদিত চট, বস্তা, থলে বিদেশে রপ্তানি হত।

রপ্তানিতে উল্লম্ফন

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রোববার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি এসেছে ১২ শতাংশের মতো।

পাটের তৈরি এসব পণ্য রপ্তানি হয়।

গত অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলারে পণ্য রপ্তানি করে সঙ্কটে পড়া চামড়া খাতকে (৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার) পেছনে ফেলে তৈরি পোশাকের পরের স্থান দখল করে নেয় পাট খাত। চলতি অর্থবছরেও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

করিম জুট স্পিনার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহিদ মিয়া বলেন, এখন শুধু বস্তা, চট ও থলে নয়, পাটসুতাসহ পাটের তৈরি নানা ধরনের পণ্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে।

“কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিশ্বে পাট পণ্যের চাহিদা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। এই সুযোগটি যদি আমরা নিতে পারি তাহলে আমাদের এ খাতের রপ্তানি অনেক বাড়বে; এই মহামারীর বছরেই আমরা আমাদের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হব।”

তবে এজন্য এই মুহূর্তে একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

ইপিবি’র তথ্যে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে পাটসুতা (জুট ইয়ার্ন) রপ্তানি হয়েছে ২১ কোটি ৮ লাখ ২০ হাজার ডলারের; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। কাঁচাপাট রপ্তানি হয়েছে ৪ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার ডলার; আয় বেড়েছে ২৩ দশমিক ৬১ শতাংশ।

পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রপ্তানি হয়েছে ৩ কোটি ৫১ লাখ ৯০ হাজার ডলারের। আয় বেড়েছে ৩৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। পাট ও পাট সুতা দিয়ে হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৩ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

এছাড়া পাটের তৈরি অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হয়েছে ২ কোটি ৩ লাখ ৯০ হাজার ডলার।

২০২০-২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পন্য রপ্তানি থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১১৬ কোটি ৭০ লাখ (১.১৬ বিলিয়ন) ডলার।

তবে মহামারী না থাকলে এই লক্ষ্য গত অর্থবছরেই অর্জিত হতো বলে মনে করেন বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান এম সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অর্থবছরের শেষ তিন মাসে করোনাভাইরাসের ধাক্কা না লাগলে গত অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি ২৫ শতাংশের মতো বেড়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মতো ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যেত।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি করে ১০২ কোটি (১.০২ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ওই একবারই এ খাতের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল।

সোহেল বলেন, তিন মাসের যে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে এই খাত থেকে রপ্তানি আয় দেড় বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে।

কেন তিনি আশাবাদী, তার ব্যাখ্যায় বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কমলেও পাটপণ্যের চাহিদা কমবে না। খাদ্যের জন্য ফসল ফলাতেই হবে, আর সেই ফসল মোড়কজাত বা বস্তাবন্দি করতে পাটের থলে লাগবেই।”

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটককের ফরিদপুর প্রতিনিধি শেখ মফিজুর রহমান শিপন এবং মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি আব্দুল মমিন]