প্রণোদনার টাকার জোয়ারে মূল্যস্ফীতি বাড়ার শঙ্কা

করোনাভাইরাস মহামারীর ক্ষতি সামলে উঠতে সরকার সহজ শর্তে এবং কম সুদে সোয়া লাখ কোটি টাকার যে প্রণোদনা দিচ্ছে, সেই টাকা বাজারে এসে মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর শঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2020, 05:22 PM
Updated : 29 Sept 2020, 05:29 PM

খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, কোভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবেলা করতে টাকার জোগান বাড়ানোর ফলে পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতায় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এতে বেড়ে যেতে পারে মূল্যস্ফীতির হার।

দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গত রোববার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ ত্রৈমাসিক (এপ্রিল-জুন) প্রতিবেদনে এই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) গতি বাড়ানো এবং বাজারে ভারসাম্য বজায় রাখতে নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের উপর নজর বাড়ানোর সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

“যাতে কোনো অবস্থাতেই টাকার প্রবাহ উৎপাদন খাতের বাইরে বেশি না যায়। একই সঙ্গে এসব অর্থ অর্থনীতির মূল ধারায় ঘূর্ণায়মান থাকে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ আশঙ্কা যৌক্তিক বলে মানছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

তারা বলেছেন, প্রণোদনায় বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে গেছে। আর এই টাকা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে-এটাই অর্থনীতির স্বাভাবিক সূত্র।

এ পরিস্থিতিতে খুব বেশি সতর্ক থাকতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছেন এই দুই অর্থনীতিবিদ।

মহামারীর প্রভাব মোকাবেলায় বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়িয়েছে সরকার

করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিতে ধস নামানোর পর দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার ২০টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। এই অঙ্ক জাতীয় বাজেটের এক-পঞ্চমাংশের বেশি।

এই প্রণোদনার অর্ধেকের বেশি অর্থ ঋণ হিসেবে ইতোমধ্যেই পেয়েছেন বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তারা। সহজ শর্তে এবং কম সুদে এই ঋণ পেয়েছেন তারা। এই সব ঋণের সুদে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে।

দেশে গত কয়েক বছর ধরে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়েই রয়েছে।

২০০৭-০৮ অর্থবছরে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে তা নিম্নমুখী।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা কমে ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে আসে।

এপর থেকে মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

আর পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সর্বশেষ অগাস্টে এই হার কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ দাঁড়িয়েছে।

আহসান এইচ মনসুর

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও গত কয়েক বছর ধরে দেশে ফসলের ভালো ফলন হয়েছে। বিশ্ববাজারেও জ্বালানি তেল ও খাদ্য পণ্যের দাম কম ছিল। সে কারণে দেশে মূল্যস্ফীতিও লাগামের মধ্যেই ছিল।

অর্থনীতির পরিভাষায়, বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়লে চাহিদা তৈরি হয়। তখন স্বাভাবিক নিয়মে পণ্যের ওপর চাপ পড়ে। এতে দাম বেড়ে যায়। ফলে বাড়ে মূল্যস্ফীতির হার। এতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উপর বাড়তি চাপ পড়ে।

আহসান মনসুর বলেন, “এখন পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। বাজারে ইতোমধ্যে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আটা, শাকসবজি, মাছ, মাংসসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়তির দিকে। কোভিড-১৯ এর কারণে সরবরাহ চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, বন্যার প্রভাব ও কারসাজির কারণে এগুলোর দাম বেড়েছে।

“এর সঙ্গে বাজারে প্রণোদনার টাকার প্রবাহ বাড়ায় মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা রয়েছে।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে টাকার প্রবাহ বেড়েছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে তা বাড়িয়ে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

গত জুন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। আগামী জুনের মধ্যে তা ১৯ দশমিক ৩ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

একই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ৮ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত করা হবে।

মহামারীতে বিপুল সংখ্যক মানুষ আয় হারানোয় বাজারে টাকার জোগান বাড়াতে এরকম বহুমুখী পদক্ষেপ নেয় সরকার।

এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই জোগান দেওয়া হচ্ছে ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে আমানতকারীদের জমা অর্থের নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা জমা রাখার বিধি-বিধানেও ছাড় দেওয়া হয়েছে।

 ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর টাকার প্রবাহ প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।

এসব অর্থ সহজ শর্তে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এতে বাজারে টাকার প্রবাহজনিত মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মহামারীর প্রভাব মোকাবেলায় টাকার জোগান বাড়ানোর বিকল্প না থাকলেও তার তার উপর নজরও রাখতে হবে।

সালেহ উদ্দিন আহমেদ

“সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে ব্যাংকের মাধ্যমে যেসব টাকা বের হবে, সেগুলো যাতে উৎপাদন খাতে ব্যবহৃত হয় এবং মেয়াদ শেষে ফেরৎ আসে।”

“উৎপাদন খাতের চেয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে বেশি টাকা গেলে, টাকা ফেরত না এলে বা বিদেশে পাচার হয়ে গেলে অর্থনীতিতে আরও বড় ঝুঁকি তৈরি হবে,” হুঁশিয়ার করেন তিনি।

সালেহ উদ্দিন বলেন, মন্দার মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যেমন চমক বা ম্যাজিক দেখানোর সুযোগ থাকে, তেমনি কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এর সুফল ঘরে তুলতে হয়।

“এটি বড় চ্যালেঞ্জিং। এর জন্য কঠোর সুপারভিশন থাকতে হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, উন্নত ও উদীয়মান দেশগুলোর অর্থনীতি করোনাভাইরাসের প্রভাব সীমিত করে লকডাউনের আওতা থেকে পর্যায়ক্রমে বেরিয়ে আসছে। সচল হতে শুরু করেছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।

এর সঙ্গে সমন্বয় রেখে বাংলাদেশের অর্থনীতিও পুরোমাত্রায় সচলের দিকে এগুচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে ইতোমধ্যেই সরকারের পক্ষে আর্থিক ও রাজস্ব নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে অদূরভবিষ্যতে দেশের সার্বিক অর্থনীতি স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসতে পারে।

অর্থনৈতিক ভারসাম্য রাখতে এখন রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ানোর উপর জোর দিয়ে জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানোয় নজর দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

পাশাপাশি মহামারীর কারণে যেসব শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছে তাদের বিদেশে পাঠানো এবং কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে সুপারিশ করা হয়।