বুধবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ‘সরকারি ক্রয়ে সুশাসন: বাংলাদেশে ই-জিপি’র কার্যকরতা পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ই-জিপি প্রবর্তনের ফলে ম্যানুয়াল থেকে কারিগরি পর্যায়ে সরকারি ক্রয়ের উত্তরণ ঘটলেও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের একাংশ দুর্নীতির নতুন পথ খুঁজে নিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গবেষণার জন্য ই-জিপি বাস্তবায়নকারী প্রথম দিকের চারটি প্রতিষ্ঠান- স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ), বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে (আরইবি) বাছাই করা হয়। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে সারা দেশে চারটি প্রশাসনিক বিভাগের একটি করে জেলা এবং সে জেলার একটি উপজেলা পর্যায়ে (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) অবস্থিত কার্যালয় ও ঢাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘ট্রাফিক সিগন্যাল পদ্ধতিতে’ চলেছে এই গবেষণা।
গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৫০ শতাংশ স্কোর পেয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ)। ৪৪ শতাংশ স্কোর পেয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ (আরইবি), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ৪৩ শতাংশ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) পেয়েছে ৪২ শতাংশ। অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠানের অবস্থানই ‘ভালো নয়’ গ্রেডে।
সবগুলো প্রতিষ্ঠানই প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশ স্কোর পেয়ে মোটামুটি ভালো ও প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে আছে, তবে সওজ ও আরইবির সক্ষমতা অন্য দুটো প্রতিষ্ঠান থেকে তুলনামূলকভাবে ভালো। ই-জিপি প্রক্রিয়া মেনে চলার ক্ষেত্রে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই ৫৮ শতাংশ থেকে ৬৪ শতাংশ স্কোর পেয়ে কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। ই-জিপি ব্যবস্থাপনা এবং কার্যকারিতায় কোনো প্রতিষ্ঠানই কোনো স্কোর পায়নি।
আবার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে সব প্রতিষ্ঠানের স্কোর ১৯ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থাৎ হতাশাব্যঞ্জক। প্রাপ্ত গ্রেড অনুযায়ী সব প্রতিষ্ঠানের অবস্থান সার্বিকভাবে ঘাটতিপূর্ণ। ই-জিপি ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি এবং কার্যকরতায় অবস্থান উদ্বেগজনক। যেসব নির্দেশকে অবস্থান উদ্বেগজনক সেগুলো হচ্ছে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা, প্রাক-দরপত্র সভা, ই-চুক্তি ব্যবস্থাপনা, কার্যাদেশ বাস্তবায়ন তদারকি, নিরীক্ষা, কর্মচারীদের সম্পদের তথ্য প্রকাশ, অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং কাজের মান।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি স্কোর পেয়েছে সওজ (৭৫ শতাংশ); এর পরেই রয়েছে পাউবো (৬৩ শতাংশ)। সবগুলো প্রতিষ্ঠানেই ই-জিপি পরিচালনার জন্য আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে এবং ই-জিপি পরিচালনার জন্য আলাদা করে অর্থ বরাদ্দেরও দরকার নেই।
ভৌত ও কারিগরি সক্ষমতার দিক থেকে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঘাটতি লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে সওজ এবং আরইবির সক্ষমতা তুলনামূলক বেশি। এলজিইডি (উপজেলা পর্যায়) ও পাউবোতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের ঘাটতি রয়েছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে।
ই-জিপি গাইডলাইন অনুযায়ী ই-জিপি পরিচালনা করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রতিষ্ঠান ভেদে সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্রয় ই-জিপিতে হয় না। উপজেলা পরিষদের ক্রয়ে অনেক জায়গায়ই ই-জিপি পুরোপুরি চালু হয়নি। সামরিক বাহিনীর দ্বারা সম্পাদিত কাজের ক্ষেত্রে ই-জিপি অনুসরণ করা হয় না। এছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা দেওয়া হয় না।
গবেষণা অনুযায়ী ই-জিপি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি স্কোর পেয়েছে সওজ (৬৪ শতাংশ); এর পরেই রয়েছে পাউবো (৬০ শতাংশ)। ই-জিপি গাইডলাইন অনুযায়ী সব ই-জিপি ব্যবহারকারীদের ই-জিপি ব্যবস্থায় নিবন্ধিত হওয়া বাধ্যতামূলক হলেও তিন ধরনের প্রতিষ্ঠান ই-জিপিতে নিবন্ধিত- ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদার ও ব্যাংক। ই-জিপি চালুর প্রথম দিকে অধিংকাশ ঠিকাদারই সংশ্লিষ্ট অফিসের সহায়তায় ই-জিপিতে নিবন্ধিত হয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৬,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকার বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার অপারেটরদের মাধ্যমে ই-জিপি আইডি খোলা ও নিবন্ধন সম্পন্ন করেছে। তবে কোনো কোনো ঠিকাদার নিজেই নিবন্ধন করেছে।
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত সবগুলো প্রতিষ্ঠানে টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন কমিটি (টিইসি) গঠন ও দরপত্র মূল্যায়ন করা হয়। সওজ ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠানে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে দরপত্র মূল্যায়ন করা হয় না। কোনো কোনো সময় টিইসির সদস্যদের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার অপারেটররা তাদের পক্ষে লগ-ইন করে দরপত্র খোলেন। দরপত্র খোলার আগে ঠিকাদারদের পরিচয় গোপন থাকার নিয়ম থাকলেও কোনো প্রতিষ্ঠানেই এটি গোপন থাকে না। কোনো কোনো কার্যালয়ের অফিসের কম্পিউটার অপারেটররাই টাকার বিনিময়ে ঠিকাদারদের হয়ে দরপত্র দাখিল করে। কোনো প্রতিষ্ঠানই প্রাক-টেন্ডার মিটিং করে না।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ই-জিপির প্রবর্তন হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম এর ফলে সরকারি ক্রয় খাতে সুশাসন ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আশানুরূপ ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো ই-জিপির ফলে ক্ষেত্র বিশেষে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলেও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাজের মানন্নোয়নে এর কোনো প্রভাবই পড়েনি। ই-জিপি ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি এবং কার্যকরতার মতো তিনটি মৌলিক ক্ষেত্রেই অবস্থান উদ্বেগজনক।
“সার্বিকভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘাটতি রয়েছে। এর পেছনে মূলত রাজনৈতিক প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমাদের দেশে রাজনীতিকে সম্পদ বিকাশের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত রয়েছে, যা থেকে সরকারি ক্রয় খাতও মুক্ত নয়।”
১৩ দফা সুপারিশ
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল ও সার্বিক পর্যবেক্ষণের আলোকে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা উত্তরণে এবং ই-জিপির কার্যকর সুফল পেতে টিআইবি ১৩ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করেছে।
উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হল- ই-জিপিকে রাজনৈতিক প্রভাব, যোগসাজশ ও সিন্ডিকেটের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করতে হবে; সেই লক্ষ্যে সব পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও জনগুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির রাষ্ট্রের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যবসায়িক সম্পর্কের সুযোগ বন্ধ করতে হবে; প্রত্যেক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের ক্রয় ই-জিপির মাধ্যমে করতে হবে; কাজের চাপ ও জনবল কাঠামো অনুযায়ী ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে জনবল বাড়াতে হবে; সব অংশীজনকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে; প্রাক-দরপত্র মিটিং নিশ্চিত করতে হবে; ঠিকাদারদের অনলাইন ডেটাবেইজ তৈরি করতে হবে; সমন্বিত স্বয়ংক্রিয় দরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকতে হবে; দরপত্র সংক্রান্ত সব তথ্য ও সিদ্ধান্ত স্বপ্রণোদিতভাবে প্রকাশ করতে হবে; ই-জিপির সাথে জড়িত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিজস্ব ও পরিবারের অন্য সদস্যদের আয় ও সম্পদের বিবরণী প্রতিবছর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে ও তা প্রকাশ করতে হবে।
গবেষণা পদ্ধতি
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশের সরকারি ক্রয় খাতে সুশাসনের আঙ্গিকে ই-জিপির প্রয়োগ ও কার্যকরতা পর্যালোচনা করার উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
তথ্য সংগ্রহের জন্য ই-জিপি বাস্তবায়নকারী প্রথম দিকের চারটি প্রতিষ্ঠান- স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ), বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবিকে) বাছাই করা হয়।
সারা দেশে চারটি প্রশাসনিক বিভাগের একটি করে জেলা এবং সে জেলার একটি উপজেলা পর্যায়ে (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) অবস্থিত কার্যালয় ও ঢাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গুণগত ও সংখ্যাগত উভয় পদ্ধতি অনুসরণ করে চারটি প্রতিষ্ঠানের ৫২টি কার্যালয় থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘ট্রাফিক সিগন্যাল পদ্ধতি’ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, ই-জিপি প্রক্রিয়া, ই-জিপি ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং কার্যকরতা- এই পাঁচটি ক্ষেত্রের অধীনে ২০টি নির্দেশকের ভিত্তিতে সরকারি ক্রয় আইন কতটুকু কার্যকর তা পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রত্যেক নির্দেশককে উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন স্কোর দিয়ে তাদের অবস্থান বোঝানো হয়েছে। স্কোরের গ্রেডগুলো হচ্ছে ‘ভালো’ (৮১ শতাংশ বা তার বেশি); ‘সন্তোষজনক’ (৬১ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ); ‘ভালো নয়’ (৪১ শতাংশ-৬০ শতাংশ); ‘উদ্বেগজনক’ (৪০ শতাংশ বা তার নিচে)।
প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। গবেষণা ও পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাহিদ শারমীন ও শহিদুল ইসলাম ছিলেন গবেষক দলের সদস্য।