দারিদ্র্য বিমোচনের ভাতা ‘সঠিক হাতে’ যাচ্ছে না: সিপিডি

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য যেসব কর্যক্রম পরিচালনা করছে, সেই সুবিধা অনেক ক্ষেত্রে সঠিক ব্যক্তির কাছে পৌঁছাচ্ছে না বলে মনে করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2020, 02:55 PM
Updated : 16 Sept 2020, 02:55 PM

পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভের বরাত দিয়ে বেসরকারি এ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, সরকারের বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কেবল ৩২.৫ শতাংশকে সুরক্ষা জালের আওতায় আনতে পারছে। অন্যদিকে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের দেওয়া ভাতার জন্য যারা তালিকাভুক্ত, তাদের ১৯.৮ শতাংশ আদৌ দরিদ্র নন।

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের কার্যকারিতা নিয়ে বুধবার এক ভার্চুয়াল সংলাপে সিপিডির রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান এই তথ্য তুলে ধরেন। 

মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, সরকার দরিদ্র মানুষের মধ্যে যেসব ভাতা দিচ্ছে, তার মধ্যে মাতৃকালীন ভাতা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বৃত্তি, হত দরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন প্রকল্প এবং বয়স্ক ভাতার কর্মসূচি দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ‘অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ’।

“ন্যায়ভিত্তিক গুরুত্ব দিয়ে এই পাঁচটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে সরকার যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) নিয়ে কাজ করছে, তার বাস্তবায়নেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।”

গত বছরের শেষ দিকে সিপিডি পরিচালিত এক সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরে তৌফিকুল ইসলাম বলেন, উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের গাইবান্ধা জেলার প্রায় ৬৬ শতংশ, কুড়িগ্রামে প্রায় ৪৩ শতাংশ, নীলফামারিতে ৪১ শতাংশ এবং রংপুরে ৪৩ শতংশ দরিদ্র মানুষ সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির সুফল ভোগ করছেন।

“কিন্তু সিপিডি পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, যারা দরিদ্র না, তারাও এই তালিকায় এসে যাচ্ছেন।”

জরিপের তথ্য তুলে ধরে সিপিডির রিসার্চ ফেলো বলেন, এসব জেলায় মাধ্যমিক স্কুলে ৭২ শতাংশ উপবৃত্তি পাচ্ছে ‘দরিদ্র নয়’- এমন পরিবারের সন্তানরা।

একইভাবে কর্মসৃজন প্রকল্পের সুবিধাভোগীর মাত্র এক তৃতীয়াংশ দরিদ্র; বাকি দুই তৃতীয়াংশ ‘দরিদ্র নন’ বলে তথ্য দেন তৌফিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, অনকে সময় প্রচারের অভাবে অনেক দরিদ্র মানুষ তালিকাভুক্ত হতে আবেদন করেন না। কোথায় গিয়ে অভিযোগ করতে হবে- তাও তারা জানেন না। আবার তালিকাভুক্ত অনেকেই আছেন, যারা কাজ করার উৎসাহ বোধ করেন না।

“এমনিতেই এসব কর্মসূচিতে বরাদ্দ কম। তার মধ্যে এভাবে ভাগ হয়ে যাওয়ার ফলে সত্যিকার দরিদ্র মানুষের কাছে খুব কম অর্থ যাচ্ছে।”

তবে বর্তমান সরকারের সময় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা যে বেড়েছে, সেই তথ্য তুলে ধরে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ২০১০ সালের আগে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ২১ শতাংশ এসব কর্মসূচির আওতায় ছিল, এখন তা ৩২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

তৌফিকুল ইসলাম বলেন, সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে এমনিতেই সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য কম বরাদ্দ রাখতে হয়। এ খাতে সরকার এখন জিডিপির ৩ শতাংশের মত বরাদ্দ দিচ্ছে। সেখান থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন বাদ দিলে থাকে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।

“চাহিদার তুলনায় যদি বরাদ্দ কম হয়, তখন সঠিক লোক বাছাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

জরিপের তথ্য তুলে ধরে তৌফিকুল ইসলাম বলেন, মাতৃত্বকালীন সময়ে দরিদ্র মায়েরা যে ভাতা পান, তা বছরে তিন বা চারবারে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন সুফলভোগীরা।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় এ অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।

তিনি বলেন, “দরিদ্র মায়েদের মাতৃত্বকালীন সময়ে পুষ্টি যোগানোর উদ্দেশ্যে মাতৃত্বকালীন ভাতা দেওয়া হয়। তাই এই ভাতা একবারে না দিয়ে বছরে চারবারে দেওয়ার জন্য আমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের বলব।”

তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে চলমান কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য একটি ‘পারফেক্ট ডেটাবেইজ’ তৈরি করতে পারলে ‘সবচেয়ে ভালো’ হবে।

স্থানীয় পর্যায়ে সঠিক সুফলভোগীর সঠিক তালিকা তৈরি হয় না মন্তব্য করে এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দেশপ্রেমের ঘাটতির কথা বলেন মন্ত্রী।

“আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি আমরা দেশপ্রেমে শিক্ষিত না হই, তাহলে আমরা যখন দরিদ্র, হত দরিদ্র্য, বয়স্ক ভাতাসহ সরকারের বিভিন্ন ভাতার জন্য তালিকা তৈরি করি, তখন মেম্বার বা চেয়ারম্যানরা যদি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ না হন, তাহলে আসলে সঠিক তালিকা হয় না।”

তিনি বলেন, “এখন যে তালিকা রয়েছে সেখানে অনেক দুর্বলতা আছে। তাই আমাদের আরও চেষ্টা করতে হবে যাতে আমরা সঠিক একটি ডেটাবেইজ তৈরি করতে পারি। তখন মানুষ ন্যায়বিচারটা পাবে।”

মন্ত্রী বলেন, বাচ্চারা যেন স্কুলে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সেজন্য বাসার চেয়ে স্কুলের পরিবেশ উন্নত করতে হবে।

“অর্থাৎ যে বাচ্চাটা স্কুলে যাচ্ছে, সেখানে যদি তার বাসার চেয়ে খারাপ পরিবেশ হয়, তাহলে সে বাসায় চলে যেতে চাইবে। আর স্কুলের পরিবেশ যদি বাসার চেয়ে ভালো হয়, তাহলে সে স্কুলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।”

তিনি বলেন, তালিকাভুক্ত যারা সরকারের বিভিন্ন ভাতা পান, তা বিতরণে ব্যাংকগুলোর চার্জ মওকুফ করে দিলে ভালো হয়। তা না হলে সরকারের পক্ষ থেকে ওই চার্জ দিয়ে দেওয়া হবে।

সরকারের কর্মসৃজন প্রকল্পের মাধ্যমে শ্রমিকদের যে ২০০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে, সেটা ৫০০ টাকায় উন্নীত করা যায় কিনা- সে চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী।

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গাইবান্ধা ও রৌমারির কয়েকটি এলাকা থেকে সরকারের কর্মসূচির সুফলভোগী কয়েকজন ভার্চুয়াল এই আলোচনায় অংশ নেন।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূত রেন্সজে টিরিংক সরকার পরিচালিত দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিগুলোর স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা রক্ষা করার আহ্বান জানান।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দরিদ্র মানুষের একটি তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সরাসরি তাদের কাছে অর্থ পৌঁছাতে পারলে তারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। দারিদ্র্য দূর করার জন্য এর উৎস খুঁজে সমাধান বের করতে হবে।

সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পারভীন আক্তার বলেন, গর্ভবতী মায়েদের জন্য সরকারিভাবে দুই বছর পর্যন্ত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তাদেরকে পুষ্টির যোগান ও বাচ্চাদের সঠিক পরিচর্যার বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।

সিপিডি ও অক্সফাম ইন বাংলাদেশের আয়োজনে এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের সহযোগিতায় আয়োজিত এ সংলাপে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।