সময় বাড়িয়েও বোরো সংগ্রহের লক্ষ্য অর্জন হচ্ছে না

সরকারিভাবে এবার সাড়ে ২১ লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সময় বাড়িয়ে তার অর্ধেকও পূরণ হচ্ছে না।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলাম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Sept 2020, 06:07 AM
Updated : 11 Sept 2020, 06:07 AM

সারা দেশে এবার দুই কোটি মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদন হলেও সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের সঙ্গে বাজারের দামের তফাৎ থাকায় সরকারের সঙ্গে চুক্তির পরেও মিলাররা চাল না দেওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

মিল মালিকরা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারীর সঙ্গে বন্যার কারণে অনেক মিল ক্ষতির মুখে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চালকল মালিকরা লস দিয়ে সরকারকে চাল সরবরাহ করতে চাচ্ছে না।

খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চুক্তি অনুযায়ী কারা চাল দিয়েছে আর কারা দেয়নি, সংগ্রহের সময়সীমা শেষ হলে সেই তালিকা করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে সরকারকে চাল না দেওয়ার পেছনে বৈরি আবহাওয়াসহ মিলারদের অন্য কোনো সমস্যা ছিল কি না, সেসব বিষয় আমলে নেওয়া হবে বলে খাদ্য সচিব জানিয়েছেন।

খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি এবার ২৬ টাকা কেজি দরে বোরো ধান, ৩৬ টাকা কেজিতে সিদ্ধ ও আতপ চালসহ ১৯ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন বোরো ধান-চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে সরকারিভাবে বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা আরও দুই লাখ মেট্রিক টন বাড়িয়ে সাড়ে ২১ লাখে উন্নীত করা হয়।

গত ২৬ এপ্রিল থেকে ধান এবং ৭ মে থেকে বোরো চাল সংগ্রহ শুরু হয়; গত ৩১ অগাস্ট তা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেই সময় বাড়িয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই লাখ ১৩ হাজার ৬৭ মেট্রিক টন বোরো ধান, পাঁচ লাখ ৯৮ হাজার ৭৪৮ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল এবং ৮৮ হাজার ৬০৪ মেট্রিক টন আতপ চালসহ মোট আট লাখ ৮৮ হাজার ৯১৭ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহ করা হয়েছে; চালের আকারে যা আট লাখ ২৫ হাজার ৮৪৫ মেট্রিক টন।

অন্যদিকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি গুদামে ১৪ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ১১ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন চাল এবং দুই লাখ ৬৯ হাজার মেট্রিক টন গম।

কেন এবার বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না, সেই প্রশ্নে খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যাদের ধান-চাল দেওয়ার কথা ছিল তারা তা সরবরাহ না করায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

“হাস্কিং মিলগুলো এবার বৃষ্টিবাদলের কারণে ধান কিনতে পারেনি, বাজারে দামও বেশি ছিল। তারা এমনিতেই মরাধরা, তাদের বিরুদ্ধে কী অ্যাকশন নেব? এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই, আমরা তাদের মোটিভেশন করার চেষ্টায় আছি।”

সরকারের সঙ্গে চুক্তির পরেও যেসব অটোমেটিক রাইস মিল চাল সরবরাহ করেনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান খাদ্য সচিব।

“যারা চুক্তির পরেও চাল দেবে না তারা যাতে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে কোনো সুবিধা না পায় সে বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, ডিসিসহ সংশ্লিষ্ট সব পর্যায়ে বলেছি।”

খাদ্য সচিব জানান, চুক্তি মেনে যারা সরকারকে চাল সরবরাহ করেছে তাদের আলাদা তালিকা করা হচ্ছে। যারা ধান-চাল সরবরাহ করেনি তাদের তালিকাও আলাদা করা হচ্ছে।

“যারা শতভাগ চাল সরবরাহ করেছে ভবিষ্যতে তাদের ইনসেনটিভ দেব। যারা দেয়নি ভবিষ্যতে তাদের বঞ্চিত করার পরিকল্পনা আমাদের আছে।”

সরকার ধান-চাল কেনার যে দাম নির্ধারণ করেছিল, বাজারে তার থেকে বেশি দাম থাকায় অনেক মিল সরকারকে চাল দেয়নি বলে জানান খাদ্য সচিব।

তিনি বলেন, “চুক্তি বলবতের ক্ষেত্রে বাজার পরিস্থিতিটাও দেখতে হবে। সংগ্রহের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর সার্বিক বিষয় আমরা বিবেচনা করব, কারা ডিফল্টার হল।

“যারা একবারেই দেবে না তারা কী কারণে দিতে পারল না সেটা আমরা পর্যালোচনা করে দেখব। ক্যাপাসিটি থাকার পরেও দেয়নি, নাকি অন্য কোনো কারণ আছে, সেসব বিষয় দেখা হবে। সবার ক্ষেত্রে সমান ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। আমরা মূল্যায়ন করে কাকে কতটুকু শাস্তি কোন ফর্মে দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করব।”

সরকারের পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি ধান-চালের যে দাম নির্ধারণ করে দেয় সেখানে সমস্যা থাকছে কি না, এমন প্রশ্ন ছিল খাদ্য সচিবের কাছে।

জবাবে তিনি বলেন, “কৃষি মন্ত্রণালয় ধান-চালের উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করে দেয়, সেটার ভিত্তিতেই পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি দাম চূড়ান্ত করে।

“বাজারে কিন্তু দাম বেশি। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নির্ধারণ করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। দেশের উৎপাদন ও চাহিদা অনুসারে বাজারে কিন্তু চালের এত দাম থাকার কথা নয়। ব্যবসায়ীরা বাজারে দাম বাড়িয়ে ফেলছেন। লজিক্যালি বাজার বাড়ার কোনো কারণ নেই। বাজারে দাম বেশি থাকলে ভোক্তা ওই দামেই কিনতে বাধ্য।”

সচিব জানান, মিল থেকে কত টাকায় চাল কিনে তা কত টাকায় পাইকারি ও খুচরা বাজারে বিক্রি করছে সেটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তদারকি করে। ৩০ টাকার চাল কেন ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সেটা দেখার দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের।

“এসব বিষয় তদারকি করার জন্য আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন সময় চিঠির পাশাপাশি মৌখিকভাবেও বলেছি। আমরা দেখছি, উৎপাদন কমেনি, চাহিদা বাড়েনি- সেই হিসেবেই আমরা দাম নির্ধারণ করি। আমরা চেষ্টা করছি আমাদের নির্ধারিত মূল্যের মধ্যেই যেন জনগণ কিনতে পারেন। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আমরা চালের দামটা বেঁধে দিতে পারি না। বাজারের দাম বেশি বেড়ে গেলে ওএমএস বা অন্য প্রোগ্রাম করে চাল বাজারে ছেড়ে দিয়ে আমরা কন্ট্রোল করি, আমরা এটা করতে পারি।”

দেশের সব কৃষক, ব্যবসায়ী ও মিলারদের কাছে কত খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে তার পুরো তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি বলে জানান খাদ্য সচিব নাজমানারা।

তিনি বলেন, “আমরা বুঝতে পারছি যত খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে তাতে ব্যবসায়ী ও মিলার ছাড়াও কৃষকের কাছে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। ফলে আমরা কিন্তু খুব একটা ক্রাইসিস বোধ করছি না। কারণ আমরা জানি যে চাহিদা অনুসারে দেশে উৎপাদন হয়েছে এবং বিদেশে রপ্তানি করিনি।”

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যাদের লস দেওয়ার ক্যাপাসিটি নেই তারা সরকারকে চাল দেয়নি। জেলে দিলেও তো এবার চাল দেওয়ার উপায় নেই।”

করোনাভাইরাসের মাহামারীর মধ্যে বাজারে যে চাল ৪১-৪২ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে সেই চাল মিলাররা সরকারকে কেন ৩৬ টাকায় দেবে, সেই প্রশ্নও তুলেন এই চালকল নেতা।

লায়েক আলী বলেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে এবার চাল দিতে গেলে অনেক মিলারকে মিল বিক্রি করে চাল দিতে হবে। করোনা ও বন্যার কারণে অনেক মিল এবার নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই হিমসীম খাচ্ছে। কী হবে জানি না।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, চালের দাম বাড়াতে মিলারদের পক্ষ থেকে কয়েক দফা মন্ত্রণালয়ে আবেদন দেওয়া হলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে মিলাররাও সরকারকে আর চাল দেয়নি।

খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মিলারদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছেও প্রচুর খাদ্যশস্য মজুদ আছে। তবে সাধারণ মানুষের কাছে ঠিক কী পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদ আছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।

“কে কতটুকু খাদ্যশস্য ধরে রেখেছে সেটা বের করাটাই মুশকিল। যেহেতু বলা হচ্ছে এবার বাম্পার ফলন হয়েছে এটা তো কোথাও না কোথাও আছে কারণ আমরা রপ্তানি করি না। ফলে সেটা বাজারে আসবে, আমরা যখন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি শুরু করব তখন ধরে রাখা শস্য বাজারে আসবে, তখন এর প্রভাব বাজারে পড়বে।”