পাট রপ্তানির পালে হাওয়া

সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হলেও পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে রপ্তানি আয় বাড়ছে; মহামারীর মধ্যে গত দুই মাসে রপ্তানি আয়ে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে এই খাত থেকেই।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Sept 2020, 01:11 PM
Updated : 5 Sept 2020, 01:11 PM

২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-অগাস্ট সময়ে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ১৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি এসেছে ১ শতাংশের মতো।

গত অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলারে পণ্য রপ্তানি করে সংকটে পড়া চামড়া খাতকে (৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার) পেছনে ফেলে তৈরি পোশাকের পরের স্থান দখল করে নিয়েছে পাট খাত।

আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ১০২ কোটি ডলার। আর পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ৮১ কোটি ৬২ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। সে হিসেবে এক বছরে চামড়ার রপ্তানি যতটা কমেছে, তার তুলনায় পাটের রপ্তানি বেড়েছে সামান্যই।

তারপরও করোনাভাইরাসের কারণে গেল অর্থবছরে তৈরি পোশাকসহ বড় সব খাতের রপ্তানি আয়ে ধস নামলেও পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয়ে বরাবরই দেখা গেছে উল্টো চিত্র।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-অগাস্ট সময়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১৫ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে ১৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

অন্যদিকে এই দুই মাসে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

গত জুলাই মাসে সরকার বিজেএমসির আওতাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলে উৎপাদন বন্ধ করে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে অবসরে পাঠায়। এই পাটকলগুলোতে উৎপাদিত চট, বস্তা, থলে বিদেশে রপ্তানি হত।

পাটের তৈরি এসব পণ্য রপ্তানিও হয়। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

এবিষয়ে বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান জাহিদ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখন শুধু বস্তা, চট ও থলে নয়, পাটসুতাসহ পাটের তৈরি নানা ধরনের পণ্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে।

“কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিশ্বে পাট পণ্যের চাহিদা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। এই সুযোগটি যদি আমরা নিতে পারি তাহলে আমাদের এ খাতের রপ্তানি অনেক বাড়বে; এই মহামারীর বছরেই আমরা আমাদের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হব।”

কৃষি অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক এম আসাদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের পাটের রপ্তানি বাজার বরাবরই ভালো ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল আদমজী বন্ধসহ একটার পর একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা সেই বাজার ধরতে পারিনি।

“এখন মহামারীর কারণে পাট ও পাট পণ্য রপ্তানির যে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, সেটা আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারব সেটাই এখন বড় বিষয়।”

পাট পণ্যের প্রদর্শনীর একটি স্টলে দর্শক।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বৃহস্পতিবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-অগাস্ট) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৬৮৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার আয় করেছে। এর মধ্যে ১৯ কোটি ৫৪ লাখ হাজার ডলার এসেছে পাট ও পাট পণ্য রপ্তানি থেকে ।

এই দুই মাসে পাটসুতা (জুট ইয়ার্ন) রপ্তানি হয়েছে ১৪ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার ডলারের; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৭ শতাংশ। কাঁচাপাট রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ৯৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার; আয় বেড়েছে ৩৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রপ্তানি হয়েছে ২ কোটি ৭ লাখ ৪০ হাজার ডলারের। আয় বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পাট ও পাট সুতা দিয়ে হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩ দশমিক ৭১ শতাংশ।।

এছাড়া পাটের তৈরি অন্যান্য পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ৩২ লাখ ৮০ হাজার ডলার।লাখ ডলারের।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ মোট ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছিল। ওই অঙ্ক ছিল আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি এসেছিল ৭ শতাংশ।

গত অর্থবছরে পাটসুতা রপ্তানি থেকে ৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। অর্থাৎ মোট রপ্তানি ৬৪ শতাংশই এসেছিল পাটসুতা রপ্তানি থেকে।

কাঁচাপাট রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ১৩ কোটি ডলার। পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রপ্তানি হয়েছিল ১০ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের।

এছাড়া পাটের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ১৯ কোটি ডলারের।

২০২০-২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পন্য রপ্তানি থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১১৬ কোটি ৭০ লাখ (১.১৬ বিলিয়ন) ডলার। 

তবে মহামারী না থাকলে এই লক্ষ্য গত অর্থবছরেই অর্জিত হতো বলে মনে করেন বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান এম সাজ্জাদ হোসাইন সোহেলল।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, অর্থবছরের শেষ তিন মাসে করোনাভাইরাসের ধাক্কা না লাগলে গত অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি ২৫ শতাংশের মতো বেড়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মতো ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যেত।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি করে ১০২ কোটি (১.০২ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ওই একবারই এ খাতের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল।

সোহেল বলেন, “দুই মাসের যে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে এই খাত থেকে রপ্তানি আয় ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে।

“করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কমলেও পাটপণ্যের চাহিদা কমবে না। খাদ্যের জন্য ফসল ফলাতেই হবে, আর সেই ফসল মোড়কজাত বা বস্তাবন্দি করতে পাটের থলে লাগবেই।“

দেশে পাটচাষির সংখ্যা ২০ লাখের মতো।

সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, বর্তমানে দেশে পাটচাষির সংখ্যা ৪০ লাখ। দেশের জিডিপিতে পাট খাতের অবদান দশমিক ২৬ শতাংশ ও কৃষি জিডিপিতে তা ১ দশমিক ৪ শতাংশ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সাড়ে সাত থেকে আট লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। যেখানে কম বেশি ৮০ লাখ বেল পাটের আঁশ উৎপন্ন হয়ে থাকে।

দেশের সব জেলাতেই কম-বেশি পাটের চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি পাটের চাষ হয় ফরিদপুর জেলায়, সেখানে এবার ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। গত মৌসুমে হয়েছিল ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে।

পাটনির্ভর এই জেলায় ১৯টি পাটকল আছে; সবগুলোই বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে সচল রয়েছে, ১৩টি।

দেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি খাতের জুট মিল করিম জুট মিল এই ফরিদপুরেই অবস্থিত। পারটেক্স গ্রুপের পারটেক্স জুট মিলও এই জেলাতেই অবস্থিত।

ফরিদপুরের জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হযরত আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৭০ শতাংশ পাট ইতোমধ্যেই কৃষক ঘরে তুলেছেন। যাদের টাকার খুব প্রয়োজন বিক্রি করে দিচ্ছেন। অনেকে বেশি দামের আশায় মজুদ করে রাখছেন।”

ফরিদপুরের বিভিন্ন হাটে এবার প্রতি মণ ভালো মাণের পাট আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে বলে জানান হযরত আলী।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার কুমারগাড়া গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‍“হাট-বাজারে ২৪০০ থেকে ২৫০০ টাকায় পাট বিক্রি হচ্ছে। আমি এখনও বিক্রি করিনি; ভালো করে শুকিয়ে ঘরে রেখে দিয়েছি। দাম আরও বাড়লে বিক্রি করব।”