আমদানি ব্যয়ের সমান রপ্তানি আয়

গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই ওলট-পালট এখন কোভিড-১৯ মহামারীতে; তার ধাক্কায় বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেক হিসাবনিকাশও উল্টে গেছে। দেখতে হচ্ছে, অনেক বিরল ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Sept 2020, 06:47 PM
Updated : 1 Sept 2020, 06:47 PM

ওলট-পালটের এই ধারায় বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো মাসে রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয় প্রায় সমান হয়েছে। আর এর ফলে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি প্রায় শুন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।

মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট) হালানাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ ৩৯১ কোটি ২০ লাখ (৩.৯১ বিলিয়ন) ডলার ব্যয় করেছে। আর তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করে আয় করেছে ৩৮২ কোটি ৬০ লাখ (৩.৮৩ বিলিয়ন) ডলার।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি যে, রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয় প্রায় সমান হয়েছে।

এই তথ্যে বিস্ময় প্রকাশ করে অর্থনীতির গবেষক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডএস) গবেষক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি আমার জীবনে এমন রেয়ার (বিরল) ঘটনা কখনও দেখিনি। প্রতি মাসেই রপ্তানির চেয়ে আমদানি ব্যয় দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার বেশি হয়েছে। এবারই প্রথম সমান হলো।

“করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি দুটোই আশঙ্কাজনকভাবে কমে গিয়েছিল। কিন্তু জুলাই মাস থেকে রপ্তানি আয় বাড়তে শুরু করলেও আমদানি ব্যয় বাড়েনি। তাই এই চাঞ্চল্যকর তথ্য দেখতে হল।”

এর আগে গত এপ্রিল মাসে রপ্তানি আয়ের চেয়ে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বেশি এসেছিল। ওই মাসে পণ্য রপ্তানি করে মাত্র ৫২ কোটি ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। আর রেমিটেন্স এসেছিল দ্বিগুণেরও বেশি ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলার।

করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারী রূপ নেওয়ার পর গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই স্থবির হয়ে পড়েছে, যা আরেকটি মহামন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীকে।

এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। মহামারীর মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশটির মোট দেশজ উ‌ৎপাদন (জিডিপি) প্রায় চার ভাগের এক ভাগ হারিয়েছে।

সোমবার প্রকাশিত সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে এপ্রিল-জুন সময়ে ভারতের অর্থনীতি ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ হারে সঙ্কুচিত হয়েছে।

ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, ১৯৯৬ সালে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে অর্থনীতির পরিসংখ্যান প্রকাশ শুরুর পর এটাই জিডিপির সর্বোচ্চ সঙ্কোচন, যেটাকে আশঙ্কাতীত বলছেন অনেক বিশ্লেষক।

জায়েদ বখত বলেন, “মহামারীর প্রকোপ বাংলাদেশেও লেগেছে। আর সে কারণেই শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি), শিল্পের কাঁচামালসহ অন্য সব পণ্য আমদানি কমেছে।

“এর ফলে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমবে।”

মহামারী চলাকালে অথবা মহামারীর প্রভাব শুরু হওয়ার আগের যে কোনো মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সব সময়ই রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার বেশি হয়েছে।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৭৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। আর আমদানি বাবদ ব্যয় করেছিল ৪৮৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

মহামারীর মধ্যে গত এপ্রিল মাসে আমদানি খাতে ব্যয় হয় ২৮৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। রপ্তানি থেকে আয় হয় মাত্র ৫২ কোটি ডলার।

আর গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ আয় করে ২৭১ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। আমদানিতে ব্যয় হয় ৪৮০ কোটি ৭৯ লাখ ডলার।

পুরো অর্থবছরের হিসাব বিশ্লেষণ করলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভন্ন পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ মোট পাঁচ হাজার ৬৯ কোটি ১০ লাখ (৫০.৬৯) ডলার ব্যয় করেছে। আর রপ্তানি থেকে আয় করেছে তিন হাজার ২৮০ কোটি ৩০ লাখ (৩২.৮৩ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবে গত অর্থবছরে পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৭৮৬ কোটি ১০ লাখ (১৭.৮৬ বিলিয়ন) ডলার।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫৮৩ কোটি ৫০ লাখ (১৫.৮৩ বিলিয়ন) ডলার।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল এক হাজার ৮১৭ কোটি ৮০ লাখ (১৮.১৮ বিলিয়ন) ডলার, যা ছিল এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১০৬ কোটি ১০ লাখ ডলার।

আমদানি কমায় চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাইয়ে সেই ঘাটতি হয়েছে মাত্র ৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার।