পরিসংখ্যানের অভাব আর শুনতে চাই না: পরিকল্পনামন্ত্রী

টেকসই উন্নয়ন অভিষ্টের (এসডিজি) মূল্যায়নে পরিসংখ্যানের অপ্রতুলতার কথা শুনে অসন্তোষ জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 August 2020, 01:23 PM
Updated : 27 August 2020, 01:23 PM

২০১৫ সাল থেকে চলমান টেকসই উন্নয়ন অভিষ্টের (এসডিজি) দ্বিতীয় মূল্যায়ন প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার উপস্থাপনের সময় পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য অধ্যাপক শামসুল আলম কিছু ক্ষেত্রে তথ্য উপাত্তের অভাবে মূল্যায়ন করতে না পারার কথা বলেন।

বৃহস্পতিবার ঢাকার শেরে বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এই প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নান।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজ, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং পরিকল্পনা সচিব আসাদুল ইসলাম অনুষ্ঠানে ছিলেন। এতে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী‘র (ইউএনডিপি) আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক শামসুল বলেন, “তবে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তথ্য উপাত্তের অভাবে মূল্যায়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।”

পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদনেও অপ্রতুল উপাত্তের কথা তুলে ধরেন তিনি। এছাড়াও অসমতা হ্রাসে উপাত্ত না থাকায় মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি বলেও তিনি জানান।

নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের লক্ষ্যে অপ্রতুল উপাত্তের কারণে মূল্যায়ন সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি।

পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নান এসব শুনে বৈঠকে উপস্থিত পরিসংখ্যান বিভাগের সচিব মো. ইয়ামিন চৌধুরীর উদ্দেশে বলেন, পরিসংখ্যানের অভাবের কথাটি তিনি আর শুনতে চান না।

জুয়েনা আজিজ বলেন, “এসডিজি বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে আমাদের মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে এবং তথ্য উপাত্তের অভাব পূরণ করতে হবে।”

প্রতিবেদনে দেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত করতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে শতভাগ সামাজিক সুরক্ষার আনার সুপারিশ করা হয়।

অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশের সার্বিক দারিদ্র্য হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশে আর হতদরিদ্রের সংখ্যা ১০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৬ সালে এই হার ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ ও ১২ দশমিক ২ শতাংশ।

তিনি বলেন, এক্ষেত্রে এসডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্য নির্মূল করতে সম্পদ সংগ্রহ, মধ্যম আয়ের ফাঁদ, এসডিজির জন্য অর্থায়ন, মানসম্পন্ন তথ্য উপাত্ত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে প্রধানটি অর্থাৎ দারিদ্র্য বিমোচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপায় বাতলে দিয়ে শামসুল বলেন, “এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সরকার পরিচালিত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে নিয়ে আসতে হবে। অর্থনৈতিক সম্পদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মৌলিক সেবায় তাদের অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে।”

তিনি বলেন, “এজন্য শিল্পায়নে বিনিয়োগ সংগ্রহ এবং বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার জন্য পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে হবে।”

দারিদ্র্য বিমোচনে সরকার এ পর্যন্ত সঠিক পথেই আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“এসডিজির দ্বিতীয় লক্ষ্য ‘ক্ষুধা মুক্তি’র ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্বল হলেও অগ্রসরমান।

তৃতীয় লক্ষ্য, সুস্বাস্থ্য ও সামাজিক কল্যাণ খাতের অগ্রগতি কিছুটা দুর্বল হলেও অগ্রসরমান। মাতৃ মৃত্যুর হার ২০১৫ সালে লাখে ১৮১ জনের বিপরীতে ২০১৯ সালে ১৬৫ জনে নেমে এসেছে। এটাও ভালো।”

চতুর্থ লক্ষ্য মান সম্মত শিক্ষায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষার হার ৩৯ শতাংশ থেকে ৭৭ শতাংশে উন্নীত হওয়াকেও সন্তোষজনক বলেন অধ্যাপক শামসুল।

“এক্ষেত্রে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি জ্ঞান বিতরণে দক্ষ শিক্ষক সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে। এছাড়াও শিক্ষা সংক্রান্ত সরকারি সেবার বিকেন্দ্রীকরণ, অবকাঠামোভিত্তিক ও অর্থনৈতিক অসমতা ঘোচাতে হবে।”

পঞ্চম লক্ষ্য লিঙ্গ সমতায় ১৫ বছরের কম বয়সী ২৩ দশমিক ৮ শতাংম নারীর বিয়ে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ১৫ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

এক্ষেত্রে পারিবারিক কাজে বৈষম্য, সমমানের কাজে অসম মজুরী, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও সহিংসতা রোধে জেন্ডার সংবেদনশীল তথ্যের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক শামসুল।

সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার ৭৮ শতাংশ থেকে ৯২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক শামসুল বলেন, এক্ষেত্রে টেকসই ও আধুনিক জ্বালানির ক্ষেত্রে পরিমিত মাত্রায় দুর্বল, তবে অগ্রসরমান।

শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি খাতেও কিছুটা উন্নতি হলেও যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

শিল্পে উদ্ভাবন ও অবকাঠামোর লক্ষ্যে কিছুটা উন্নতি হলেও তা যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক শামসুল।

“ব্যবসা পরিচালনায় উচ্চ ব্যয় গুণগত অবকাঠামোর অভাব, ভূমি ব্যবস্থাপনা সংকট, দক্ষ মানব সম্পদের অভাব বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সীমাবদ্ধতা এক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে।”

টেকসই নগর ও জনবসতির ক্ষেত্রে দুর্বল ও স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত নিরপাদ ও সাশ্রয়ী আবাসন, সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য এবং টেকসই নগর পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন তেমন একটা হয়নি।

এছাড়া সম্পদের সীমাবদ্ধতা ঢাকা অন্যান্য শহরের প্রধান প্রধান অংশীজনের মধ্যে সমন্বয় নীতিসমুহ কৌশলের মধ্যে ছন্দের অভাব রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক শামসুল।

জলবায়ু কার্যক্রমের লক্ষ্যে ২০১৫ সালে প্রতি লাখে ১২ হাজার ৮৮১ জন ক্ষতিগ্রস্থ থেকে এখন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ৪ হাজার ৩১৮ জন মানুষ।

এক্ষেত্রে অভিবাসন সমস্যা সামাল দেওয়া, চাকরির নিরাপত্তা ও কয়েক মিলিয়ন মানুষের সম্পদ রক্ষা এবং জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থ ছাড়ে ধীরগতি চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

জলজ জীবনের ক্ষেত্রে দুর্বল ও স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে মত জানিয়ে শামসুল আলম বলেন, জনসংখ্যার চাপ, অবৈধ, অগোচরীভূত ও অনিয়ন্ত্রিত মাছ শিকার, সমুদ্র গবেষণা সম্পর্কিত সেবা এবং নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক তথ্য ও উপাত্তের অভাব এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ।

স্থলজ জীবন লক্ষ্য অর্জনে খুবই দুর্বল এবং অবনতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান ও অভিষ্ট অর্জনে অংশীদারিত্ব লক্ষ্য বাস্তবায়নে ও দুর্বল ও স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক শামসুল।

পরিকল্পনান্ত্রী বলেন, “বাল্য বিবাহ একটা অত্যাচারের পর্যায়ে পড়ে। এটি আমাদের উন্নয়ন করতে হবে।”

তিনি বলেন, “ব্যবসা সহজীকরণের বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।”

তবে কৃষি খাতে বিদেশি বিনিয়োগের চেয়ে দেশীয় বিনিয়াগ বেশি প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।

জুয়েনা আজিজ এসডিজির সঙ্গে সমন্বয় করে উন্নয়নের গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, “যেখানে পিছিয়ে আছে সেখানেই উন্নয়ন করতে হবে। আমরা আশাবাদী আমরা পারব।”

ইউএনডিপি‘র প্রতিনিধি সুদীপ্ত মূখার্জি বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এসডিজি বাস্তবায়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”

তিনি বিশেষ করে কাঁকড়া চাষিরা রপ্তানি করতে না পারায় এ খাতে বিপুল ক্ষতির কথা বলেন।