চল্লিশ বছর আগে ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ছিল মাত্র ১২ কোটি ১০ লাখ ডলার।
Published : 21 Aug 2020, 05:12 PM
এখন সেই রিজার্ভ তিন হাজার ৮০০ কোটি (৩৮ বিলিয়ন) ডলারের সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করছে। বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বেশি রিজার্ভ আগে কখনোই ছিল না। রপ্তানি আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ায় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে এই মাইলফলক অতিক্রম করেছে।
তবে এই দীর্ঘ পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। কখনও কখনও হোঁচট খেয়েছে। আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে। অনেক সময় রাজনীতিতেও ইস্যু হয়েছে এই রিজার্ভ; বাড়লে, সরকারের সাফল্য হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। যেমনটি এখন করা হচ্ছে। আবার কমে গেলে বিরোধী দলের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে।
রিজার্ভ ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে এলে ‘ভাবমূর্তি নষ্ট হবে’ বলে ২০০১ সালে প্রথমবারের মত এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল বাকি রাখতে বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেষ দিকে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। এরপর বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন রিজার্ভে ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি।
সে সময় আকুর বিল বাবদ ২০ কোটি ডলার পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু তাতে রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসত। আর রিজার্ভ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ দাতাদের সহায়তা পাওয়া যাবে না- এই বিবেচনায় আকুর দেনা পুরোটা শোধ না করে অর্ধেক দেওয়া হয় তখন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ওই একবারই আকুর বিল বকেয়া রাখা হয়েছিল বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশকে দুই মাস পরপর পরিশোধ করতে হয় আকুর বিল।
প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয়ের খরচ হিসাবে বর্তমানে হাতে থাকা রিজার্ভ দিয়ে প্রায় সাড়ে নয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
১৯৭১ থেকে ২০২০ সাল। ৪৯ বছর, কিছু দিন পর অর্ধশতাব্দী। যে কোনো দেশের উন্নতি-অবনতি, ভালো-মন্দ বিচারের জন্য অনেক সময়। রিজার্ভের নিরিখেই যদি বিচার করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের অগ্রগতি অসামান্য।
স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানিরা বলত, স্বাধীন হলে তোমরা খাবে কী? পাট, চা ও চামড়া এই তিন পণ্য রপ্তানি করে কি তোমাদের ভাত-কাপড় হবে? আরও মারাত্মক কথা বলেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। পাকিস্তানিদের এ দোসর স্বাধীনতার পর বলেছিলেন, “বাংলাদেশ একটা তলাবিহীন ঝুড়ি।”
কিন্তু বাংলাদেশ যে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয়, উল্টো অনেক ক্ষেত্রেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে. তা দুদেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি তুলনা করলেই প্রমাণ মেলে।
গত জুলাই শেষে পাকিস্তানের রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন ৩৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। এ তথ্যই বলছে, পাকিস্তানের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি রিজার্ভ এখন বাংলাদেশের।
১২ কোটি ১০ লাখ ডলার দিয়ে শুরু
স্বাধীনতার পর প্রায় এক দশক বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়নের (রিজার্ভ) কোনো তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নেই। হয়ত, ওই সময়ে পণ্য রপ্তানি থেকে তেমন কোনো আয় দেশে আসেনি। রেমিটেন্সও আসা শুরু হয়নি; বিদেশি ঋণ-সহায়তাও মেলেনি। তাই রিজার্ভে কোনো বিদেশি মুদ্রার মজুদও ছিল না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, ১৯৮১-৮২ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে বিদেশি মুদ্রার মজুদ জমতে শুরু করে। ওই অর্থবছর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি ১০ লাখ ডলার।
পাঁচ বছর পর ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর শেষে সেই রিজার্ভ বেড়ে হয় ৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ১৯৯১-৯২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলারের ‘ঘর’ অতিক্রম করে ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে উঠে। পরের ১৯৯২-৯৩ অর্থবছর শেষেই রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছর শেষে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর শেষে তা কমে ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা আরও কমে ১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
এরপর ১৯৯৭-৯৮ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত রিজার্ভ দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের মধ্যে উঠানামা করে।
২০০০-০১ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। ওই অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার থাকলেও অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে তা ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। তখনই আকুর বিল পুরোটা পরিশোধ না করে অর্ধেক করা হয়েছিল।
এরপর অবশ্য কখনই রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি আসেনি। ২০০১-০২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে হয় ১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার।
২০০৫-০৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ৫ বিলিয়ন ডলার অত্রিক্রম করে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।
এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বেড়েই চলেছে অর্থনীতির এই সূচক।
২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ‘ঘর’ অতিক্রম করে। পরের বছর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১৬ সালের জুনে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।
মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ পাঁচ বার রেকর্ড গড়েছে।
গত ৩ জুন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ জুন সেই রিজার্ভ আরও বেড়ে ৩৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।
এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ৩০ জুন রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। এক মাস পর ২৮ জুলাই রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরও অতিক্রম করে।
তিন সপ্তাহ পর গত ১৭ অগাস্ট রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।
এই দেড় মাসে ৩৪ বিলিয়ন ডলার থেকে রিজার্ভ ৪ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ৩৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।
খুশি অর্থমন্ত্রী
করোনাভাইরাস মহামারীকালে রিজার্ভ রেকর্ড গড়ায় খুবই খুশি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের উপর ভর করেই রিজার্ভ একটার পর একটা রেকর্ড গড়ছে।”
এই কঠিন সময়ে বেশি বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অবদান রাখার জন্য তিনি প্রবাসীদের কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
তিনি একই সঙ্গে বলেন, “এই রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে সরকারের বড় ভূমিকা আছে। বৈধ পথে রেমিটেন্স আনতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গত বছরের জুলাই থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
“অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে সরকার তার সঙ্গে ২ টাকা যোগ করে স্বজনকে ১০২ টাকা দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রবাসীরা উৎসাহিত হচ্ছেন। বেশি রেমিটেন্স দেশে পাঠাচ্ছেন।”
আত্মতুষ্টিতে না ভোগার পরামর্শ আহসান মনসুরের
তবে রিজার্ভ বৃদ্ধিতে আত্মতুষ্টিতে না ভোগার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতির গবিষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। রেমিটেন্স বাড়ার কারণে রিজার্ভ বেড়েছে ঠিক। কিন্তু আমদানি ব্যয় কমাও কিন্তু রিজার্ভ বাড়ার একটি কারণ। এছাড়া গত তিন-চার মাসে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো যে বিদেশি ঋণ-সহায়তা এসেছে সেটাও রিজার্ভ বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।
“পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। সে পরিস্থিতিতে যদি রেমিটেন্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি ঋণ এখনকার মতো না আসে তখন কিন্তু রিজার্ভে চাপ পড়বে।”