মহামারীকালে বিদেশি ঋণের রেকর্ড

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে গত জুন মাসে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ঋণ-সহায়তা হিসেবে রেকর্ড ১৯৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2020, 03:38 AM
Updated : 20 August 2020, 03:43 AM

এর আগে কখনোই এক মাসে এত বেশি বিদেশি ঋণ দেশে আসেনি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জুন মাসে ১৪৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের ঋণ এসেছিল; যেটা ছিল এতোদিন সর্বোচ্চ।

অর্থবছরের হিসেবেও বিদেশি ঋণে রেকর্ড হয়েছে এবার। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে সব মিলিয়ে দাতাদের কাছ থেকে ৭২৭ কোটি ২০ লাখ ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এই অংক আগের বছরের চেয়ে ১৭ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।

এই ঋণের অর্ধেকেরও বেশি, ৩৭৬ কোটি ৮৮ লাখ ডলার এসেছে, মহামারীকালের চার মাস- মার্চ থেকে জুনের মধ্যে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাওয়া ৬২১ কোটি ডলার ছিল এতদিন এক অর্থবছরে পাওয়া বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ঋণ-সহায়তা।

 

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলার জন্য সরকার অভ্যন্তরীণভাবে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের পাশাপাশি অর্থনীতির ক্ষতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরে দাতাদের কাছে ঋণ-সহায়তার আবেদন করেছিল। তারাও বেশ ভালো সাড়া দিয়েছে।”

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে গত অর্থবছরের শেষ তিন মাস দেশের অর্থনীতি একপ্রকার অচল হয়েই ছিল। তাতে যতটা সঙ্কটে পড়ার কথা ভাবা হচ্ছিল, বিদেশ থেকে থেকে ‘ভালো’ ঋণ-সহায়তা পাওয়ায় ততটা সঙ্কটে সরকারকে পড়তে হয়নি বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যে অবস্থা হয়েছিল, তাতে অর্থের জন্য সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছিল। এক সময় মনে হচ্ছিল, সরকারের ব্যাংক ঋণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

“কিন্তু বিদেশি ঋণের কারণেই অর্থবছরের শেষ দিকে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমে এসেছে। শেষ পর্যন্ত ৬০ হাজার কোটি টাকার মত নিতে হয়েছে।”

বাংলাদেশের বিদেশি মুর্দ্রার রিজার্ভ যে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে, তাতেও এই বিদেশি ঋণের অবদান দেখছেন আহসান মনসুর।

এক সময় বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ সহায়তা পাওয়ার জন্য ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বৈঠকে বসতে হত বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের।

‘প্যারিস কনসোর্টিয়াম’ হিসেবে পরিচত সেই বৈঠকে বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশল, পরিকল্পনা ও অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা হত। বিভিন্ন শর্তে রাজি হলে বছরে দেড়শ থেকে দুশ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি মিলত।

আর গত অর্থবছরের শেষে এক মাসেই ওই পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ বিদেশি ঋণ হিসেবে পেয়েছে।

২০০২ সালের পর থেকে প্যারিসের বদলে ঢাকাতেই দাতা ও উন্নয়নসহযোগীদের নিয়ে বৈঠক করছে বাংলাদেশ। এখন একে বলা হয় বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) বৈঠক।

বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার বিদেশি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে দাতাদের কাছ থেকে যে ৭২৭ কোটি ২০ লাখ ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ, তার মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক দিয়েছে ১৩০ কোটি ডলার।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অর্থবছর হিসাব করে জানুয়ারি-ডিসেম্বর ক্যালেন্ডার ধরে। ২০১৯ সালে এডিবির কাছ থেকে ১৩০ কোটি ডলার পেয়েছিল বাংলাদেশ। আর চলতি ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সময়েই দিয়েছে ১২০ কোটি ডলার।

করোনাভাইরাস সঙ্কট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত অর্থবছরে সরকারকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলার দিয়েছে। এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি) দিয়েছে ৫০ কোটি ডলার।

বাকিটা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন-জাইকা, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক-আইএসডিবি এবং অন্যান্য দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া গেছে।

আইএমএফের ৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের পুরোটাই করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ব্যয় করার জন্য দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এডিবির ৫০ কোটি ডলার, বিশ্ব ব্যাংকের ২৫ কোটি ডলার এবং এআইআইবির ২৫ কোটি ডলার ব্যয় হবে কোভিড-১৯ সংসট মোকাবেলায়।

অর্থমন্ত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মহামারী মোকাবেলার জন্য আমরা অভ্যন্তরীণভাবে এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি। সেগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে। পোশাক শ্রমিকদের বেতনের জন্য প্রথমে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল করা হয়েছিল। পরে সেই তহবিলে আরও তিন হাজার কোটি টাকা যোগ করা হয়েছে, এর ইতিবাচক ফলও পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে।”

অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স, আমদানি, রপ্তানি আয়সহ সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। দেশের অর্থনীতি আস্তে আস্তে শক্তি ফিরে পাচ্ছে।

“সব মিলিয়ে আমরা এখন বেশ সাহস পাচ্ছি। সাহসিকতার সঙ্গে কোভিড-১৯ মোকাবেলা করতে পারব বলে আশা করছি।”