সোনার দোকানে এখন বিক্রি নেই, আছে কেনার চাপ

সোনার দোকানগুলো গহনা বিক্রির পাশাপাশি কিনেও থাকে, যদিও তা সামান্য। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীকালে এখন চিত্র পুরো উল্টে গেছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 August 2020, 03:06 PM
Updated : 11 August 2020, 03:30 PM

গহনা ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন বিক্রি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছে, বরং কেনার জন্যই দোকান খোলা রাখতে হচ্ছে তাদের।

ঢাকার বায়তুল মোকাররম জুয়েলারি মার্কেটের শারমিন জুয়েলার্সের মালিক এনামুল হক খান দোলন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সারা দেশে সোনার গহনা বিক্রি শূন্যের ঘরে নেমে এসেছে। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এমন অবস্থা হয়নি।

“করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে মানুষের হাতে টাকা-পয়সা নেই। অলংকার কিনবে কী দিয়ে? অভাবের তাড়নায় যার কাছে যে সোনা আছে, তাই বিক্রি করে দিচ্ছে।”

সোনার দাম এখন বেড়ে যাওয়ায় সঙ্কটকালে বিকল্প পথ না খুঁজে অনেকে সোনা বিক্রি করাকেই সহজ সমাধান ভাবছেন বলে মনে করেন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সভাপতি এনামুল।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব গত মার্চে দেখা দেওয়ার পর লকডাউনে বহু মানুষের জীবিকা সঙ্কটে ফেলে দেয়। বিধিনিষেধ উঠে এলেও পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি।

মহামারীকালে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের চাকরি টিকলেও বেতন কমে গেছে কিংবা অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।

এমনই ঘটনার শিকার হয়ে এক গৃহিনীকে তার বিয়ের সময়ে পাওয়া গহনা বিক্রি করতে দেখা গেল সোমবার দুপুরে বায়তুল মোকাররম মার্কেটে।

বেসরকারি চাকরিজীবী স্বামীর বেতনের সঙ্গে প্রতি মাসে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে আসা কিছু টাকা দিয়ে তাদের চারজনের পরিবার মোটামুটি মসৃণভাবেই চলছিল।

কিন্তু মহামারীতে তার স্বামীর বেতন দুই মাস ধরে বন্ধ। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে যে বাড়িতে থাকেন, তার ভাড়া মেটানোও দায় হয়ে উঠছিল বলে হাত দিতে হয়েছে শখের বিয়ের গহনায়।

দুই ভরি সোনার অলঙ্কার বিক্রি করে মধ্যবয়সী এই নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, “কী আর করব ভাই, এখন আর চলছে না।

“করোনাভাইরাস সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। এখন দামও বেশ বেশি; তাই দুই ভরি বিক্রি করে দিলাম। প্রয়োজনও মিটবে, দামও বেশি পাওয়া গেল।”

ফাইল ছবি

এই চিত্র শুধু ঢাকার নয়, দেশের অন্য খানেও।

নিজের একে ভরি সোনার গহনা বিক্রি করে পাবনার চাটমোহরের এক নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টাকার খুব দরকার ছিল। দামও এখন বেশি পাওয়া যাচ্ছে; তাই বিক্রি করে দিলাম।”

চাটমোহরের রায় জুয়েলার্সের মালিক রনি রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের দোকানে এখন কোনো ক্রেতা আসে না। তবে অনেকেই বিক্রি করতে আসেন।”

তবে সোনা বিক্রির কারণ হিসেবে দাম বেড়ে যাওয়াকেও দেখান তিনি।

“অভাবে পড়ে যে মানুষ গহনা বিক্রি করতে আসছেন, তেমনটা না। দাম বেশি পাওয়ার কারণেই বিক্রি করে দিচ্ছেন। অনেকে ভাবছেন, এত বেশি দাম আর কখনই পাওয়া যাবে না। অযথা এত দামি জিনিস বাড়িতে রেখে লাভ কী; যদি দাম কমে যায়। তাই বিক্রি করে দিচ্ছেন।”

কোভিড-১৯ মহামারীতে অর্থনীতিতে স্থবিরতার মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের বাজারেও সোনার দাম বেড়েই চলেছে।

সবচেয়ে ভালো মানের (২২ ক্যারেট) প্রতি ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) সোনার অলংকার এখন ৭৭ হাজার ২১৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশে এর আগে কখনই এত বেশি দামে সোনা বিক্রি হয়নি।

এছাড়া ২১ ক্যারেট ৭৪ হাজার ৬৬ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৬৫ হাজার ৩১৮ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনার ভরি বিক্রি হচ্ছে ৫৪ হাজার ৯৯৬ টাকায়।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে জনসমাগমের মতো অনুষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে আছে। আর সেই কারণে সোনার গহনার দোকানেও এখন ক্রেতা নেই।

বিক্রির ক্ষেত্রে ২০% কম দাম

যারা সোনার গহনা বিক্রি করছেন, বর্তমান বাজার দরের চেয়ে ২০ শতাংশ কম দরে তা কিনছেন ব্যবসায়ীরা।

অর্থাৎ এখন যে পরিমাণ অলঙ্কার কিনতে এক লাখ টাকা লাগবে, সেই পরিমাণ অলঙ্কার বিক্রি করে ৮০ হাজার টাকা পাওয়া যাচ্ছে।

বাজুস সভাপতি এনামুল হক খান দোলন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাজুসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বরাবরই আমরা কেউ সোনার গহনা বিক্রি করতে আসলে বাজার দরের চেয়ে ২০ শতাংশ কম দামে কিনে থাকি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও এই একই ধরনের নিয়ম প্রচলিত আছে।”

ফাইল ছবি

মফস্বল শহরে সাধারণত সনাতনী পদ্ধতির সোনার গহনা বেচাকেনা হয়। সেক্ষেত্রে কেউ বিক্রি করতে গেলে কষ্টি পাথরে মেপে অলংকারে কতটুকু খাঁটি সোনা আছে, তার উপর দাম নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।

জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি ভরি ২২ ক্যারেটে ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ, ২১ ক্যারেটে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ, ১৮ ক্যারেটে ৭৫ শতাংশ বিশুদ্ধ সোনা থাকে।

সনাতন পদ্ধতির সোনা পুরনো অলঙ্কার গলিয়ে তৈরি করা হয়। এ ক্ষেত্রে কত শতাংশ বিশুদ্ধ সোনা মিলবে, তার কোনো মানদণ্ড নেই।

অলংকার তৈরিতে সোনার দরের সঙ্গে মজুরি ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) যোগ করে দাম ঠিক করা হয়।

বন্ধক রেখে ঋণ

সঙ্কটকালে অনেকে আবার শখের জিনিসটি একেবারে বিক্রি না করে বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাংকের মতো সুদ দিতে হচ্ছে।

দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সোনার অলংকার বিক্রির প্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড এই ঋণের ব্যবস্থা করেছে।

প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানবিক কারণেই আমরা এই ঋণের ব্যবস্থা করেছি। আমরা চাই না, এই কঠিন সময়ে মানুষ তার শখের জিনিসটি বিক্রি করে দিক; বিয়ের এনগেজমেন্টের স্মৃতিটা বিক্রি করে দিক।

“আমরা কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছি। কেউ আমাদের শোরুমগুলোতে গহনা বিক্রি করতে আসলে, আমরা তাদের গহনাটি না কিনে, সেটি রেখে দিয়ে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিচ্ছি। যখন তার অবস্থা ভালো হবে, তখন সে টাকা ফেরত দিয়ে গহনা নিয়ে যাবে। এরজন্য অবশ্য আমরা একটা চার্জও নিচ্ছি। এটাকে সুদও বলতে পারেন।”

ফাইল ছবি

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “ধরেন, কেউ এক লাখ টাকার গহনা নিয়ে আসল, তাকে আমরা ৮০ হাজার টাকা দিচ্ছি। দুই-তিন মাসে এর জন্য হয়ত তাকে এক-দেড় হাজার টাকা সুদ দিতে হবে। এই রকম আর কী।”

বাজুসের সাধারণ সম্পাদক আগরওয়ালা পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, “সত্যিই মানুষের খুব খারাপ অবস্থা রে ভাই! অনেকে চক্ষু লজ্জায় মুখ খুলে কিছু বলতেও পারে না। প্রতিদিন দেড়শ থেকে দুইশ জন মানুষকে এভাবে টাকার জোগান দিচ্ছি আমরা।”

তিনি বলেন, “মহামারীর এই পাঁচ মাসে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আরও ক্ষতি দিয়ে হলেও আমরা ক্রেতা হারাতে চাই না, তাদের ধরে রাখতে চাই।”

দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি আগরওয়ালা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রাখতেই দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়াতে হয়েছে।

“আমরা যদি দাম না বাড়াই, তাহলে আমাদের এখান থেকে গোল্ড অবৈধ পথে বিদেশে পাচার হয়ে যাবে।”

তবে সামনে দম কমার আশা দেখিয়ে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজার এখন একটু নিম্নমুখী। গত দুই দিনে কিছুটা কমেছে দাম। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে আমরাও সোনার দাম কমিয়ে দেব।”