রেমিটেন্স: রেকর্ডের পর ধসের শঙ্কা

করোনাভাইরাস মহামারীর শুরুতে মার্চে কিছুটা হোঁচট খেলেও এরপর থেকে দেশের প্রবাসী আয়ে চলছে ঊর্ধ্বমুখী ধারা। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রেকর্ডের পর কোরবানির ঈদ ঘিরে জুলাইয়ে রেমিটেন্স নিয়ে প্রত্যাশাও ছাপিয়ে গেছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 August 2020, 11:30 AM
Updated : 8 August 2020, 02:38 PM

বিশ্লেষকরা বলছেন, মহামারীর মধ্যে অবৈধ পথ (হুন্ডি) প্রায় বন্ধ হওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠানো বাড়ায় হিসাবে তার প্রতিফলন হয়েছে।

তাছাড়া দেশে স্বজনদের বাড়তি চাহিদা পূরণে এবং অনেকে চাকরি হারিয়ে বা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে দেশে ফিরতে জমানো সব অর্থ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাই বৈশ্বিক আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেও রেমিটেন্স বেড়েছে।

তবে রেমিটেন্সে রেকর্ডের পর রেকর্ডের ধারা কতদিন অব্যাহত থাকবে, তা নিয়ে উদ্বেগ থাকার যথেষ্ট কারণ আছে। অগাস্ট মাসের রেমিটেন্সের হিসাবেই তার প্রতিফলন মিলতে পারে বলে কেউ কেউ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাইয়ে দেশে ২৬০ কোটি ডলারের রেমিটেন্স এসেছে, যা এক মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স ছিল গত জুন মাসে ১৮৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার।

আর গত বছরের জুলাইয়ে রেমিটেন্স এসেছিল ১৫৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। সে হিসেবে আগের বছরের জুলাইয়ে চেয়ে ৬৩ শতাংশ ও চলতি বছরের জুনের চেয়ে এই জুলাইয়ে ৪২ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স এসেছে।

আর সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রেমিটেন্স আরও বেড়ে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ (১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন) ডলারে দাঁড়িয়েছে, টাকার অংকে যা ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা।

এই রেমিটেন্স ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। এর আগে এক অর্থবছরে এত রেমিটেন্স কখনই আসেনি।

এবিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী ছাইদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন করোনাভাইরাসের কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সব কিছু বন্ধ থাকায় হুন্ডিও প্রায় বন্ধ। সেই কারণে ব্যাংকের মাধ্যমেই অর্থ পাঠাতে হচ্ছে বলে হিসাবও বাড়ছে।”

প্রবাস থেকে বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থের একটি অংশ দেশে আসে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আসে না বলে ওই অর্থটি হিসাবের বাইরে থেকে যায়।

এছাড়া রেমিটেন্সের গতি ধরে রাখতে গত অর্থবছরে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল সরকার। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরেও এই ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

সেটাও রেমিটেন্স বাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়, কেননা বৈধ পথে অর্থ পাঠালেই কেবল এই প্রণোদনা পাওয়া যাচ্ছে।

মদিনা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিলমাসিহ নামক স্থানে মরুভূমির মাঝে একটি কৃষিখামারে কাজ করছেন বাংলাদেশিরা।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১৬৮টি দেশে প্রবাসীরা অবস্থান করছেন। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল- এই দশ বছরে ৬০ লাখ কর্মী বিভিন্ন দেশে গমন করেছে।

সব মিলিয়ে ১ কোটি ২১ লাখ ১২৪ জন পুরুষ ও মহিলা কর্মী বর্তমানে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই মহামারীকালে পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনে সর্বশেষ জমানো টাকা দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অনেকে আবার দেশে ফিরে আসার চিন্তা-ভাবনা করছেন; তাই যা কিছু আছে সব আগেই দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এ সব কারণেই রেমিটেন্স বেড়েছে।

“তবে এরপর কী হবে, সেটাই চিন্তার বিষয়। আমার ধারণা, চলতি অগাস্ট মাস থেকেই রেমিটেন্স কমে যাবে।”

করোনাভাইরাস মহামারী গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই স্থবির করে দিয়েছে। বাংলাদেশের জনশক্তি যে সব দেশে বেশি রয়েছে, তেলের দাম কমে যাওয়ায় সেই মধ্যপ্রাচ্যেও দেখা দিচ্ছে সঙ্কট।

তাছাড়া মহামারীর কারণে অনেক কর্মীকে বিদেশ থেকে দেশে ফিরতে হয়েছে। তাদের পুনরায় ফিরে যাওয়াও অনিশ্চয়তায় পড়েছে ।

আহসান মনসুর বলেন, “বিদেশে অনেকেরই এখন কাজ নেই। অনেকেই দেশে চলে এসেছেন। নতুন করে কেউ কোনো দেশে যাচ্ছেন না।

“যারা বিভিন্ন দেশে আছেন তাদের একটি অংশ যদি দেশে চলে আসে, তাহলে ভবিষ্যতে রেমিটেন্স আসবে কোত্থেকে?”

রেমিটেন্সে রেকর্ডের পথরেখা

২০০১-০২ অর্থবছরে ২৫০ কোটি ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, টাকার অংকে যা ছিল ১৪ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা।

দেড় যুগ পর শুধু জুলাই মাসেই ২৬০ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে বাংলাদেশে। টাকার হিসাবে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি।

তবে ১৮ বছর আগে বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল দুই লাখের মত। প্রতি বছরই তা বাড়তে বাড়তে এখন কোটি ছাড়িয়েছে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়।

আর প্রবাসীদের পাঠানো এই কষ্টার্জিত অর্থ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রতিনিয়ত অবদান রেখে চলেছে।

বিভিন্ন বছরে প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ঘেঁটে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে মাত্র ১ কোটি ডলার দিয়ে দেশে রেমিটেন্স আসা শুরু হয়। ওই বছরে বিদেশে কি পরিমাণ বাংলাদেশি কর্মরত ছিলেন তার পরিসংখ্যান অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেওয়া নেই।

১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে দেশে রেমিটেন্স আসে ৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। তখন বিভিন্ন দেশে প্রবাসীর সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার।

১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে ১৮ হাজার প্রবাসী দেশে পাঠান ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার। ১৯৭৮-৭৯ অর্থবছরে ২৫ হাজার প্রবাসীর হাত ধরে আসে ১২ কোটি ২০ লাখ ডলার। ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে ২৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার পাঠান ২৭ হাজার প্রবাসী।

এভাবেই বাড়তে থাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি; তারসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে রেমিটেন্স।

১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে ৭৮ হাজার প্রবাসীর হাত ধরে বাংলাদেশে আসে ৫৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার রেমিটেন্স। ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে এক লাখের মত প্রবাসী পাঠান ৭৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে এক লাখ ৮১ হাজার প্রবাসী পাঠান ১২১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০০১-০২ অর্থবছরে দুই লাখ প্রবাসী পাঠান ২৫০ কোটি ৩০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স।

২০০৫-০৬ অর্থবছরে রেমিটেন্সের অংক বেড়ে হয় ৪৮০ কোটি ২০ লাখ ডলার। প্রবাসীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় তিন লাখে।

২০১০-১১ অর্থবছরে প্রবাসীর সংখ্যা বেড়ে হয় প্রায় পাঁচ লাখ; রেমিটেন্স আসে ১ হাজার ১৬৫ কোটি (১১.৬৫ বিলিয়ন) ডলার।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেমিটেন্স বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ১১ লাখ ডলার।

যে কোনো দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে রেমিটেন্স। বাংলাদেশের জিডিপিতে এই রেমিটেন্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো।

অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই দীর্ঘ সময়ে দুই অর্থবছর ছাড়া প্রতি বছরই রেমিটেন্স বেড়েছে। শুধু ২০১৩-১৪ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিটেন্সে নেতিবাচক (ঋণাত্মক) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।