মহামারীকালে জুলাই মাসে রেমিটেন্সে রেকর্ড

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে কোরবানির ঈদ ঘিরে রেমিটেন্সে ঊর্ধ্বগতি আশা করা হয়েছিল, প্রত্যাশা ছাপিয়ে তা নতুন রেকর্ডও গড়েছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2020, 12:37 PM
Updated : 3 August 2020, 05:05 PM

নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মোট ২৬০ কোটি (২.৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাসে এত বেশি রেমিটেন্স আগে কখনই আসেনি।

গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে রেমিটেন্স বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। আর গত জুন মাসের চেয়ে বেশি এসেছে ৪২ শতাংশ।

এর আগে এক মাসে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছিল গত জুন মাসে ১৮৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার। আর গত বছরের জুলাই এসেছিল ১৫৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার।

কুড়ি বছর আগে ২০০১-০২ অর্থবছরের পুরো সময়ে রেমিটেন্স এসেছিল ২৫০ কোটি ১১ লাখ ডলার।

এখন এক মাসের রেমিটেন্সই তার চেয়ে বেশি। সদ্য সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট রেমিটেন্স এসেছে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৩০ লাখ (১৮.২০ বিলিয়ন) ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী ছাইদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জুলাই মাসে ২৫৯ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে জুলাই মাসে বেশি রেমিটেন্স আসবে, সেটা আগেই আভাস পাওয়া গিয়েছিল। তবে এত আসবে, কেউ কল্পনা করেনি। সত্যিই অবিশ্বাস্য!

“এই মহামারীকালে আবারও প্রমাণ হল, প্রবাসীরা আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি।”

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঈদকে কেন্দ্র করে জুলাই মাসে বেশি রেমিটেন্স আসবে, এটা প্রত্যাশিত ছিল।

“তবে, আড়াই বিলিয়ন ডলারের বেশি আসবে, এটা কারও ধারণার মধ্যে ছিল না। সত্যিই সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন আমাদের প্রবাসীরা।”

দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ বা রেমিটেন্স। দেশের জিডিপিতে এই রেমিটেন্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো।

এবার করোনাভাইরাস মহামারীতে মার্চ থেকে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ওলটপালট হয়ে যাওয়ায় রেমিটেন্সও কমে গিয়েছিল। কিন্তু এপ্রিল থেকে রেমিটেন্সে ঊর্ধগতির ধারা চলছে।

আশার সঙ্গে শঙ্কাও

রেমিটেন্সে রেকর্ড গড়লেও এই ধারা কতদিন অব্যাহত থাকবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েই গেছে।

আহসান মনসুর বলেন, “এই মহামারীকালে পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনে সর্বশেষ জমানো টাকা দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অনেকে আবার দেশে ফিরে আসার চিন্তা-ভাবনা করছেন; তাই যা কিছু আছে সব আগেই দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এ সব কারণেই রেমিটেন্স বেড়েছে।

“এরপর কী হবে, সেটাই চিন্তার বিষয়। আমার ধারণা, চলতি অগাস্ট মাস থেকেই রেমিটেন্স কমে যাবে।”

মহামারীর মধ্যে ফিরে এসেছেন অনেক প্রবাসী কর্মী (ফাইল ছবি)

করোনাভাইরাস মহামারী গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই স্থবির করে দিয়েছে। বাংলাদেশের জনশক্তি যে সব দেশে বেশি রয়েছে, তেলের দাম কমে যাওয়ায় সেই মধ্যপ্রাচ্যেও দেখা দিচ্ছে সঙ্কট।

তাছাড়া মহামারীর কারণে অনেক কর্মীকে বিদেশ থেকে দেশে ফিরতে হয়েছে। তাদের পুনরায় ফিরে যাওয়াও পড়েছে অনিশ্চয়তায়।

আহসান মনসুর বলেন, “বিদেশে অনেকেরই এখন কাজ নেই। অনেকেই দেশে চলে এসেছেন। নতুন করে কেউ কোনো দেশে যাচ্ছেন না।

“যারা বিভিন্ন দেশে আছেন তাদের একটি অংশ যদি দেশে চলে আসে, তাহলে ভবিষ্যতে রেমিটেন্স আসবে কোত্থেকে?”

রেমিটেন্সের এই গতি বাড়ার পেছনে হুন্ডি বন্ধ হওয়াও একটি কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রবাস থেকে বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থের একটি অংশ দেশে আসে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আসে না বলে ওই অর্থটি হিসাবের বাইরে থেকে যায়।

তব এখন করোনাভাইরাসের কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সব কিছু বন্ধ থাকায় হুন্ডিও প্রায় বন্ধ। সেই কারণে ব্যাংকের মাধ্যমেই অর্থ পাঠাতে হচ্ছে বলে হিসাবও বাড়ছে।

এছাড়া রেমিটেন্সের গতি ধরে রাখতে গত অর্থ বছরে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল সরকার। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরেও এই ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

সেটাও রেমিটেন্স বাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়, কেননা বৈধ পথে অর্থ পাঠালেই কেবল এই প্রণোদনা পাওয়া যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট এক হাজার ৮২০ কোটি ৩০ লাখ (১৮.২০ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা।

এই অঙ্ক আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন রেমিটেন্স এসেছিল।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল আরও বেশি; ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ।

রিজার্ভ ৩৭.৩ বিলিয়ন ডলার

রেমিটেন্সের উপর ভর করে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থান করছে। সোমবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।

প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসেবে এই রিজার্ভ দিয়ে নয় মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

এক বছর আগে গত বছরের ২৯ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ বেড়েছে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত ২৪ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২ জুলাই সেই রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

এরপর ৭ জুলাই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মাসের ৭২ কোটি ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা বেশি রেমিটেন্স পাঠানোয় সেই রিজার্ভ ২৯ জুলাই ৩৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।

আকুর জুলাই-অগাস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। তার আগ পর্যন্ত রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের উপরেই অবস্থান করবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ-এই নয়টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।