বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৩৬%

যেমন আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তাই ঘটেছে; করোনাভাইরাস মহামারীর ধাক্কায় বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 August 2020, 12:15 PM
Updated : 2 August 2020, 12:15 PM

বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের বিদেশি বিনিয়োগের তথ্য সম্প্রতি প্রকাশ করেছে।

তাতে দেখা যায়, গত অর্থবছরে ৩১৫ কোটি ৭০ লাখ (৩.১৫ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছে।

তার আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) এসেছিল ৪৯৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এ হিসাবে এক বছরে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৩৬ দশমিক ১৭ শতাংশ।

মহামারী এখনও চলতে থাকায় আগামী দিনগুলোতে এই চিত্র বদলাবে না বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।।

তারা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগ না বাড়লে দেশি বিনিয়োগও বাড়বে না, ফলে মহামারীতে ওলটপালট অর্থনীতি আরও নাজুক হয়ে পড়বে।

এ পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস মহামারী এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে চীন থেকে মুখ ফেরানো বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসবে বলে সরকার যে প্রতাশা করছে, তা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ী নেতারা।

অবকাঠামো ঘাটতিসহ নানা কারণে দেশে প্রত্যাশিত মাত্রায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না।

মিরসরাইয়ের অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর; বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য দেশে এমন ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ‍তুলছে সরকার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৩৬৮ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল, পরের মে মাসে আসে মাত্র ৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অর্থবছরের শেষ মাস জুনে এসেছে ২৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

গত অর্থবছরে নিট এফডিআই এসেছে ১৮০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) এসেছিল ২৬২ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এ হিসাবে এক বছরে নিট এফডিআই কমেছে ৩১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে।

তবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) কিছুটা বেড়েছে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে পুঁজিবাজারে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলারের নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছে ২৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের চেম্বার অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে বলেন, বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ‘ব্র্যান্ডিং’।

“বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে আমরা এখনও আমাদের ব্র্যান্ডিং যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এছাড়া আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এতদিনেও আমরা আমাদের বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি। এটা খুবই দুঃখজনক।

এছাড়া গত বছরের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে গ্রামীণফোনের (জিপি) নিরীক্ষা আপত্তির টাকা নিয়ে বিটিআরসির সঙ্গে সমস্যা বাংলাদেশে এফডিআই আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে বলে মনে করেন তিনি।

এরশাদ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ এর অর্থনীতির আকারের বিবেচনায় অনেক কম। এর মূল কারণ অবকাঠামোর ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক কূটনীতির অভাব।

“শুধু এফডিআই’র আশা করলে হবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে হবে, কার্য‌কর পদক্ষেপ নিতে হবে।”

এ বিষয়ে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন কোভিড-১৯ এর কারণে সবকিছুই ওলটপালট। এফডিআইও কমবে, এটাই স্বাভাবিক। সেটা কোথায় গিয়ে নামবে সেটাই এখন উদ্বেগের বিষয়।”

তিনি বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীন থেকে মুখ ফেরানো মার্কিনসহ অন্যান্য দেশে বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমননি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

“কেবল মুখে বললে হবে না; কার্য‌কর-সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথম যে কাজটি করতে হবে, তা হলো দেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তারপর বাড়তি বিদেশি বিনিয়োগের আশা করতে হবে।”

“আমাদের বন্দরের যে অবস্থা, এটা ঠিক না করে এফডিআই’র আশা করা ঠিক হবে না। এছাড়া অন্যান্য খাতেরও ব্যাপক সংস্কার করতে হবে,” বলেন আহসান মনসুর।

তবে এই পরিস্থিতিতেও আশাবাদী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম।

তিনি   বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অতীতেও দেখা গেছে, বড় সঙ্কটের পর বাংলাদেশের জন্য সুফলও বয়ে এনেছে।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “সবাই আশঙ্কা করেছিল ২০০৫ সালে কোটা উঠে যাওয়ার পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ধস নামবে। কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো উল্লম্ফন হয়েছে। সেই সময়ের ৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি এখন ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

“চীন থেকে মুখ ফেরানো বিদেশি বিনিয়োগ আশার যে প্রত্যাশা আমরা করছি, সেক্ষেত্রেও তেমনটি হতে পারে। তবে সেটার জন্য মহামারীতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে আমাদের। দ্রুত অর্থনীতিকে পূর্ণমাত্রায় সচল করতে হবে।”

শেখ ফাহিম বলেন, এখন সরকারি-বেসরকারি খাত মিলে ‘একসঙ্গে’ কাজ করতে হবে। সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোকে ‘আন্তরিক’ হতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি বাড়াতে হবে।

“তাহলে আমরা আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারব। আমদানি বাড়বে; রপ্তানি বাড়বে। দেশি বিনিয়োগ বাড়বে। আসবে বিদেশি বিনিয়োগ।”