আজম জানান, চারটি গরুর চামড়া ১৬০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। আর তিনটি খাসির চামড়া ‘ফ্রি’ দিতে হয়েছে।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের চৌমুহনীর এক আড়তদারের প্রতিনিধি মো. আলম জানান, ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা দরে তারা চামড়া কিনে নিচ্ছেন। কিছু লাভে সেগুলো আড়তে পাঠিয়ে দেবেন।
ঢাকার রূপনগরের মুদি দোকানি আবুল কালাম জানান, তারা এক লাখ ১০ হাজার টাকা দামের যে গরু কেরবানি দিয়েছেন, ঈদের দিন সন্ধ্যা অবধি তার চামড়া কিনতে কেউ আসেনি।
এবারের ঈদে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে সারাদেশের চিত্র এমনই। সবাই বলছেন, এবার জলের দরে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে।
গতবার চামড়া নিয়ে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল, তার সঙ্গে করোনাভাইরাস মহামারী যোগ হওয়ায় চামড়া কিনতে মৌসুমী ক্রেতা বা ফড়িয়াদের আনাগোনা এবার তেমন দেখা যায়নি।
আড়তদাররা বলে আসছিলেন, মহামারীর কারণে বিশ্ববাজারে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় ট্যানারিগুলোতে চাহিদা কমেছে। ফলে এবার চামড়ার দাম কমে যেতে পারে।
ফলে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে আরও কম দামেই কোরবানির পশুর চামড়া হাতবদল হয়েছে।
এবার ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার, যা গত বছর ৪৫ টাকা থেকে ৫০ টাকার মধ্যে ছিল। ছাগলের চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় প্রতি বর্গফুট ১৩ টাকা।
সাধারণত ৭০ হাজার টাকা থেকে ৯০ হাজার টাকা মূল্যের যেই গরুগুলো জবাই করা হয়, তার চামড়ার আয়তন ২০ থেকে ২৫ ফুট হয়ে থাকে। আর এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকার গরুগুলোর চামড়া হয় ২৫ থেকে ৩০ বর্গফুটের মধ্যে। সবচেয়ে বড় গরুগুলোর চামড়া ৩০ বর্গফুটের চেয়ে কিছুটা বেশি হয়ে থাকে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সে হিসাবে কম দামেই চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে বগুড়ার ধুনট উপজেলার চিথুলিয়া গ্রামের রাবিন সরকারকে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, তার গরুর দাম ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। হিসাব অনুযায়ী, এই গরুর চামড়ার দর ট্যানারিতে আটশ টাকার মতো হলেও তিনি বিক্রি করেছেন ৫০০ টাকায়।
ওই গ্রামের তরিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ৯৮ হাজার টাকার যে গরু তারা কোরবানি দিয়েছেন, তার চামড়া বিক্রি করেছেন ৪০০ টাকায়।
বগুড়ার গোসাইবাড়ীতে চামড়া বিক্রি করতে আসা সারিয়াকান্দির দড়িপাড়া গ্রামের ফড়িয়া মো. কালু গ্রামে গ্রামে ঘুরে ৩০টি গরুর চামড়া গড়ে ৪০০ টাকায় কিনেছিলেন, খাসির চামড়াও কিছু কিনেছিলেন গড়ে ২০ টাকায়।
“কেউ কিনতে চায় না, তাই সব মিলিয়ে বিক্রি করলাম, লোকসান হয়েছে এক হাজার টাকা,” বলেন তিনি।
ঢাকায় সাধারণত মহল্লায় পশু জবাইয়ের পর সেই চামড়াগুলো জমা হয় কাছের মসজিদ বা মাদ্রাসায়। সেখান থেকেই ফড়িয়ারা বিকাল নাগাদ দর কষাকষি করে চামড়া কিনে নেন।
শনিবার কোরবানির ঈদের দিন সন্ধ্যায় রাজধানীর শ্যামলী, আগারগাঁও, মিরপুর, রূপনগরসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এবার অনেক মসজিদ কমিটি ২১০ টাকা থেকে আড়াইশ টাকায় প্রতিটি চামড়া বিক্রি করে দিয়েছে।
আগারগাঁওয়ের জাতীয় বিজ্ঞান জাদুঘরের বিপরীত দিকে পশ্চিম আগারগাঁও বায়তুল আমান জামে মসজিদ ও হাফিজিয়া মাদ্রাসার পরিচালক রহমত উল্লাহ জানান, এবার মাত্র একজন ফড়িয়া তাদের কাছে এসেছিলেন। তিনি প্রতিটি চামড়ার দাম বলেছেন গড়ে ৬১০ টাকা। তারা তার কাছেই বিক্রি করে দিয়েছেন।
এই মসজিদে গত বছর সাড়ে চারশ চামড়া জমা পড়লেও এবার এসেছে মাত্র ৩২০টি। গতবছরও ৬৫০ টাকা থেকে ৭০০ টাকায় চামড়া বিক্রি করেছিল মাদ্রাসাটি।
মনিপুরের সিদ্দিকীয় হাফিজিয়া মাদ্রসার হিসাব রক্ষক আতিকুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত বছর ঈদের দিন দুপুর ৫০০ টাকা করে ২০০টি চামড়া বিক্রি করেছিলেন তারা। তবে সব বিক্রি করতে পারেননি।
তিনি বলেন, “এবারের পরিস্থিতি বলতে গেলে তার চেয়েও খারাপ। এবার ২১০টা চামড়া হাতে এসেছে। কিন্তু কোনো ফড়িয়া পাওয়া যায়নি। ফলে পানির দামে চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে।
“মসজিদ কমিটির সভাপতির ছেলের বন্ধু ২১০ টাকা করে চামড়াগুলো নিয়ে গেছেন। তিনি ফড়িয়া নন, হয়ত কারও মাধ্যমে বিক্রি করবেন।”
চামড়ার দাম কমায় ফড়িয়ারা উধাও হওয়ায় চট্টগ্রামে আড়তদাররা নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়েই বিভিন্ন এলাকা থেকে চামড়া কিনেছেন।
চৌমুহনীর আড়তে মো. আলম নামে এক আড়তদার প্রতিনিধি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগের বছরগুলোতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ফড়িয়ারা চামড়া নিয়ে এখানে আসত। আর আমরা তাদের কাছ থেকে কিনে নিতাম। এবার সে সংখ্যা কম।
“গতবছর অনেকেই চামড়া কিনে যে ক্ষতিতে পড়েছিলেন তা পুষিয়ে উঠতে পারেননি। যার কারণে এ বছর অনেকই চামড়ার মৌসুমী ব্যবসা করছেন না।”
আড়তদারদের প্রতিনিধি হয়ে চৌমুহনীতে অবস্থান করা একাধিক ব্যক্তি জানান, বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। আর তারা গিয়ে চামড়া নিয়ে আসছেন।
চৌমুহনী এলাকায় চামড়া নিয়ে অবস্থান করা মো. নাঈম নামে একজন জানান, তিনি আকারভেদে ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায় চামড়া সংগ্রহ করছেন। সেগুলো সামান্য কিছু বেশি দামে আড়তদাররা নিয়ে নেবেন তার কাছ থেকে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচাচামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির আহ্বায়ক মাহবুব আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে শহরের বাইরে থেকেও অনেকে কাঁচা চামড়া নিয়ে আসতেন। এবার তাদের আমরা এখানে আসতে নিষেধ করেছি।
“শহরের বাইরে যারা চামড়া বেচাকেনা করেন তাদের লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে রাখতে বলা হয়েছে। কাল পরশু তারা চামড়াগুলো আড়তে নিয়ে যাবেন। তবে এ বছর চামড়ার কোনো সংকট হবে না।”
চৌমুহনীতে আড়তদারদের প্রতিনিধিরা জানান, তারা ছাগলের চামড়া কিনছেন না। অনেকেই গরুর সাথে ছাগলের চামড়া নিয়ে এসে সেটি রেখে যাচ্ছেন।
এবছর চামড়ার দর কম হলেও কোনো ঝঞ্ঝাট যে হয়নি, তাতেই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব আলী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার চামড়ার দাম কিছুটা কম হলেও গতবারের মতো বিপর্যয় হয়নি। এটাই আপাতত স্বস্তির খবর।”
কয়েক বছর আগেও একটি গরুর চামড়া ২০০০-২২০০ টাকা এমনকি ৩ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যেত, সেই চামড়া এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়।
আফতাব বলেন, “এবার ফড়িয়ার সংখ্যা খুবই কম। তাই চামড়ার দাম কিছুটা কমে গেছে।”
ঢাকার আড়ত লালবাগের পোস্তায় মাঝারি মানের চামড়া ৭০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি; সরকারি নির্ধারিত মূল্যে কেনাবেচা করারা জন্য।”
বগুড়া জেলা চামড়া ব্যাবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মতিন সরকার বলেন, “ট্যানারিগুলো বাকি টাকা কোরবানির ঈদের আগেও পরিশোধ করেনি। টাকা দিলে চামড়ার দাম সঠিক পেত। এ কারণেই চামড়ার দাম কম।”
বাংলাদেশে সারাবছর চামড়ার যে চাহিদা, তার প্রায় অধিকাংশই মেটে কোরবানির পশুর চামড়া থেকে।
ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে মোটামুটি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, দুই দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং এক দশমিক দুই শতাংশ ভেড়ার চামড়া।