‘ঈদের সালামিতে নতুন টাকা দিতেই হয়’

ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের পাশে ফুটপাতে নতুন নোট নিয়ে চলছে অর্ধ শতাধিক হকারের হাঁক-ডাক।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2020, 04:02 AM
Updated : 30 July 2020, 04:39 AM

অন্য সময়ও এখানে নতুন নোটের পসরা নিয়ে বসেন কিছু হকার; তবে ঈদের আগে হকারের সংখ্যা যেমন বাড়ে, তেমনি বেড়ে যায় ক্রেতার সংখ্যাও।

মঙ্গলবার সেখানে ২ হাজার টাকার নতুন নোট সংগ্রহ করতে দেখা যায় ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী গোপালগঞ্জের লিয়াকত আলীকে।

জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাবো। বাড়িতে ছেলে-মেয়ে ও একটা নাতি আছে।

“ঈদের দিন এদের হাতে নতুন টাকা দিতেই হবে। তারাও নতুন টাকার জন্য মুখিয়ে থাকে। সেই জন্য কিছু টাকা বাড়তি দিয়ে নতুন টাকার বান্ডিল নিয়েছি।”

লিয়াকতের মতো ঢাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী টাঙ্গাইলের ইমদাদুল হক ইলিয়াসও এক তাড়া নতুন নোট কিনেছেন।

তিনি বলেন, “বাড়িতে চাচাত ভাই-বোন আছে, ভাগিনা-ভাগ্নি আছে। এদেরকে ঈদে সালামি দিতে হবে। এরা নতুন নোট ছাড়া নিবেই না। বাচ্চাদের আবদার তো রাখতে হয়।”

ছবি: তাবারুল হক

প্রতিবছর ঈদের আগে বাড়ি যাওয়ার সময় গুলিস্তান থেকে নতুন নোট কিনে নিয়ে যান ইলিয়াস।

ঈদের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নোট ছাড়ে প্রতিবারই। কিন্তু ব্যাংকে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর হ্যাপা এড়াতে অনেকেই ভিড় করেন গুলিস্তানে। এখানেই দেশের সবচেয়ে বড় পসরা বসে নতুন নোটের হকারদের।

এই হকাররা বলেন, সাধারণত ঈদ এলে বাড়ির বড়দের কাছ থেকে সালামি বাবদ পাওয়া টাকার নতুন নোট চায় শিশুরা। এছাড়া পূজা পার্বন, বিয়ের অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য উৎসবেও অনেকে নতুন নোট সালামি হিসেবে দিয়ে থাকেন।

তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন-বোনাস দেওয়া, দরিদ্র ও গরিবদের মধ্যে দান খয়রাত, জাকাতের টাকা, বকশিস, ভিক্ষুকদের ভিক্ষা দিতে অনেকে নতুন নোট কেনেন।

নতুন নোটের কারবারিদের অনেকেই ঈদ ছাড়াও সারা বছর ছেঁড়া ও অচল নোট নিয়ে কিছু অর্থ কেটে রেখে ব্যবসা করে থাকেন।

তবে দুই ঈদেই জমে তাদের মূল ব্যবসা; যদিও করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অন্যান্য বারের মতো ব্যবসা নেই বলে জানান হকাররা।

ছবি: তাবারুল হক

২০ বছর ধরে গুলিস্তানে নতুন টাকার কারবার করে আসছেন আব্দুর রহমান খান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এমনও ঈদ গেছে সেই সময় কোনো কোনো দিন ১০ লাখ টাকাও খাটাইতে পেরেছি। আর এখন করোনাভাইরাসের কারণে এক লাখও হয় না।”

রহমান জানান, তারা ১০০টি নোট দিয়ে প্রতিটি বান্ডিল করেন। সেই হিসেবে তারা নতুন নোট বিক্রি করে থাকেন। তবে যত ছোট মূল্যের নোট হবে বিনিময় মূল্য তত বেশি দিতে হবে।

১০ টাকা নোটের একটি বান্ডিলে এক হাজার টাকার বিনিময়ে অতিরিক্ত ৭০ টাকা নেওয়া হয়। ২০ টাকা নোটের বান্ডিলে ২ হাজার টাকার জন্যও ৭০ টাকা। একইভাবে ৫০ টাকা নোটের বান্ডিলে পাঁচ হাজার টাকার জন্য তাদেরকে ৭০ টাকা দিতে হয়।

আর ১০০ টাকা নোটের বান্ডিলে ১০ হাজার টাকার জন্য অতিরিক্ত ১০০ টাকা দিতে হয়। বাজারে নতুন নোট ২০০ টাকার বান্ডিলে ২০ হাজার টাকার জন্য অতিরিক্ত ১৫০ টাকা নেওয়া হয় বলে জানান টাকার কারবারি রহমান।

নতুন টাকার আরেক কারবারি চাঁদপুরের মো. মিজান বলেন, নতুন টাকার ব্যবসা করতে হলে লাখ লাখ টাকা পূজি লাগে। যার যতবেশি পূজি, তার তত বেশি আয়।

নোট আসার প্রক্রিয়া জানিয়ে তিনি বলেন, “কিছুদিন পর পর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নতুন নোট বিতরণ হয়। সেখানে কেউ কেউ লাইনে থেকে নোটগুলো সংগ্রহ করে। এরা আবার আমাদের কাছে অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে। কখনও কখনও লাইন দাঁড়িয়ে আমরাও সংগ্রহ করি।”

তবে করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নতুন নোট সরাসরি দেওয়া এখন বন্ধ রয়েছে জানিয়ে এক হকার বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরেই কিছু লোক আছে, তাদের কাছ থেকে কিছু অর্থের বিনিময়ে নতুন নোট সংগ্রহ করা হয়।”

ছবি: তাবারুল হক

নতুন নোটের কারবার যেভাবে শুরু

স্বাধীনতার আগে রাজধানীর ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে ছিল স্টেট ব্যাংকের কার্যালয়। স্বাধীনতার পর পর টাঙ্গালের নফিল উদ্দিন মিয়া ওই পার্কের পাশে নতুন টাকার ব্যবসা শুরু করেন বলে হকারদের ধারণা।

পরবর্তীকালে নফিল উদ্দিনের হাত ধরে এই কারবারের হাল ধরেন তার ছেলে আবুল কালাম আজাদ। আজাদ এখন নতুন টাকার কারবার করেন গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের সামনে।

৬৫ বছর বয়সী আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাবার হাত ধরেই আশির দশকের শুরুতে এই ব্যবসা শুরু করি। আমি যখন এখানে আসি তখন মাত্র আমরা তিনজন এই ব্যবসা করতাম। এখন তো বহুজন এসে যোগ দিয়েছে।”

তবে বাংলাদেশে নতুন টাকার ব্যবসা তার বাবা নফিল উদ্দিন প্রথম শুরু করেছেন কি না, সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেই তার।

এখন গুলিস্তানে যারা নতুন টাকার ব্যবসা করেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ব্যক্তি আজাদ।

তিনি বলেন, “এটা একটা সেবামূলক ব্যবসা। ধরেন আপনার একটা নোট নষ্ট হয়ে গেল বা ছিঁড়ে গেল। আপনি এই নোট নিয়ে ব্যাংকে যেতে হলে কিছু অর্থ ব্যয় হবে, সময় লাগবে।

“এই টাকা যদি আমাদের কাছ থেকে বদল করে নেন, তাহলে আপনাকে কোনো ঝামেলা পোহাতে হবে না। আমরাও কিছু উপার্জন করে সংসার চালাতে পারব।”

নতুন নোটের কারবারিরা জানান, গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স এলাকা ছাড়াও, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে, চকবাজার, গুলিস্তানের সুন্দরবন মার্কেটের সামনে বিচ্ছিন্নভাবে আরও কিছু হকার নতুন নোট বিক্রি করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ১৫ জন, চকবাজারে ১০ থেকে ১২ জন, সুন্দরবন মার্কেটের সামনে ৫ থেকে ৬ জন হকার বসেন। আর গুলিস্তানেই অর্ধ শতাধিক।