মহামারীর ধাক্কা: বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি তলানিতে

মহামারীকালে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি এ যাবতকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2020, 03:44 PM
Updated : 25 July 2020, 03:44 PM

২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৯৭ হাজার ২৭১ কোটি টাকা।

এই অংক আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে মাত্র ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি। আর মুদ্রানীতিতে ধরা লক্ষ্যের প্রায় অর্ধেক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে গত দশ বছরের বেসরকারি খাতে ঋণের তথ্য পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, গত অর্থবছরের মত এত কম প্রবৃদ্ধি এক দশকে হয়নি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের ইতিহাসেই সর্বনিম্ন।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ।

২০১৯-২০ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর বিপরীতে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ।

২০০৭-০৮ মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা খুবই উদ্বেগের যে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। কোভিড-১৯ মহামারী কমে স্বাভাবিক হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। এই অবস্থায় বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কোথায় নেমে আসবে সেটাই চিন্তার বিষয়।”

তিনি বলেন, বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক হচ্ছে বেসরকারি ঋণ। সেই ঋণ যদি না বাড়ে, তাহলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান হবে না। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে না। কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না।

“সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সরকার করোনাভাইরাসের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সেই প্রণোদনার ঋণও বিতরণ হচ্ছে না।”

এ পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কতো ধরা হবে তার হিসাব কষতে হিমশিম খাচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা।

আসছে মঙ্গলবার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতবারের মত এবারও পুরো অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ গতি হারালেও সরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে অনেক। মুদ্রানীতিতে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে সরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ৫৫ দশমিক ৫১ শতাংশ।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে ঋণের পরিমাণ আগের অর্থবছরের চেয়ে ২ দশমিক ৫১ শতাংশ কমে গিয়েছিল। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারি ঋণ আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল।

কিছু ব্যাংকের আগ্রাসী বিনিয়োগের কারণে দুই বছর আগে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে ঋণ প্রবৃদ্ধি। ওই পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালের শুরুতে বেসরকারি ঋণপ্রবাহের লাগাম টানতে ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) কিছুটা কমিয়ে আনে।

এর পর থেকে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে। এর মধ্যে কয়েক দফা এডিআর সমন্বয়ের সীমা বাড়ানো হলেও ঋণ প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত আছে।

 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমনিতেই বিনিয়োগের অবস্থা খারাপ। বেশ কিছুদিন ধরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কম। তার ওপর ব্যাংক থেকে সরকার প্রচুর ঋণ নেওয়ায় এই প্রবাহে আরও টান পড়েছে।”

তিনি বলেন, বিশাল অংকের উচ্চ খেলাপি ঋণ, তারল্য সঙ্কট, নয় ও  ছয় শতাংশ সুদ হারের ‘চক্করে’ বেসরকারি ঋণের গতি ছিল বেশ মন্থর। মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে গত অর্থবছর শেষে তা আরও নিম্নগামী হয়েছে।

“বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির বড় অংশই আসে এই বেসরকারি খাত থেকে। তাই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতেও তার প্রভাব পড়বে। কাঙ্ক্ষিত শিল্পায়ন হবে না। কর্মসংস্থানও বাধাগ্রস্ত হবে। অর্থনীতির সঙ্কট আরও বাড়বে।”

গত সাত-আট বছর ধরে দেশে বিনিয়োগ যে জিডিপির ৩১ থেকে ৩৩ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আহসান মনসুর বলেন, “সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কঠিন এই পরিস্থিতিতে দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেজন্য যদি ভালো উদ্যোক্তাদের আরও কোনো প্রণোদনার প্রয়োজন হয় সেটা দিতে হবে। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে।

“আমি এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে বলব রাজস্ব আদায়ে। যে করেই হোক রাজস্ব আদায় বাড়াতেই হবে। সরকারের ব্যয় কমাতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতনভাতা কমানোর বিষয়টিও প্রয়োজনে বিবেচনায় আনতে হবে এই মহাদুর্যোগের সময়।”

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা । এই অংক আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১০৯ শতাংশ বেশি।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার।