এক লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের এ প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে বিদেশি জনবলও বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে প্রকল্প পরিচালক মো. শৌকত আকবর জানিয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যে আমরা কাজের গতি আগের থেকে বাড়িয়েছি। রিঅ্যাক্টর ভবনের নির্মাণ কাজ এগিয়ে আছে। সব কাজ শিডিউল মতই চলছে।”
প্রকল্প পরিচালক জানান, নির্মাণ কাজের ৩০ শতাংশের পাশাপাশি প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ২৭ শতাংশ।
পাবনার রূপপুরে এ প্রকল্পের পারমাণবিক চুল্লির জন্য ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর কংক্রিটের মূল স্থাপনা নির্মাণের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের বছর জুলাইয়ে দ্বিতীয় চুল্লির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
কাজ শুরুর ৬৮ মাসের মধ্যে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল স্থাপনা নির্মাণের কথা রয়েছে রাশিয়ার কোম্পানি অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের।
রূপপুর প্রকল্প এলাকায় এক হাজার ৬২ একর জমির ওপর চলছে বিপুল কর্মযজ্ঞ। রুশ সহায়তায় এ প্রকল্পে দুই ইউনিট মিলিয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার (১ লাখ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা)।
আট হাজারের মত জনবল এখন এ প্রকল্পে কাজ করছে, যার মধ্যে ১৮০০ জন রাশিয়ানসহ বিদেশি জনবল রয়েছে প্রায় দুই হাজার।
শৌকত আকবর বলেন, ২৬ মার্চ লকডাউন শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৭৮ জন রুশ বিশেষজ্ঞ দেশে ফেরত গেছেন। অন্যদিকে তিনটি চার্টার্ড ফ্লাইটে রাশিয়া থেকে এসেছেন ৫৭০ জন। আরও ১১ জন জার্মান এসেছেন। ৮১ জন ভারতীয়কে আসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জুলাই এবং অগাস্টে আসবেন আরও প্রায় ৭৫০ জন রুশ বিশেষজ্ঞ।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে থাকলে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ৩১ মের পর সীমিত পরিসরে অফিস-যানবাহন চলাচল শুরু হয়।
মহামারীর ধাক্কায় দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের মত কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি থমকে যায়।
এর মধ্যেও রূপপুরের কীভাবে কাজ এগিয়ে চলছে জানতে চাইলে শৌকত আকবর বলেন, “তিন রকম পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। কাজে যোগ দেওয়ার আগে প্রতিদিন তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। কারো তাপমাত্রা বেশি থাকলে সাত দিনের জন্য বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হচ্ছে। এরপর আবার পরীক্ষা করে সুস্থ মনে হলে তাকে কাজে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মানতে ২৪ ঘণ্টার জন্য সূচি করে কর্মীদের আলাদা গ্রুপ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক। ক্যান্টিনে বসে খাওয়ার ক্ষেত্রেও দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে।
কোয়ারেন্টিনের জন্য আলাদা আবাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। বিদেশ থেকে যারা আসছেন, তাদের করোনাভাইরাস পরীক্ষার ‘নেগেটিভ’ রিপোর্ট সঙ্গে আনতে হচ্ছে। আসার পর ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে। কোয়ারেন্টিন শেষে পরীক্ষা করে কাজে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
“নতুন কর্মী, সে দেশি বা বিদেশি যেই হোক, করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করেই কাজে যোগ দিতে হয়।”
কর্মরতদের মধ্যে কারো করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়লে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে- এ প্রশ্নের উত্তরে শৌকত আকবর বলেন, “যদি ভেতরে কারও অসুস্থতা ধরা পড়ে, তাহলে আমরা ওই শিফটের সবার কাজ বন্ধ রাখছি। সবাইকে ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে রাখছি। নতুন গ্রুপ করে ওই শিফট আবার চালু করা হচ্ছে।”
এসব ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে নির্মাণ কাজে এখনও কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়নি বলে জানান প্রকল্প পরিচালক। তবে প্রকল্পে কতজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন সে তথ্য দিতে তিনি রাজি হননি।
তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মাণ করা হচ্ছে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্বলিত এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এখন পর্যন্ত প্রথম রিঅ্যাক্টর ভবনের কনটেইনমেন্ট ওয়াল দৃশ্যমান। ঢালাই কাজ অব্যাহত রাখতে অতিরিক্ত শ্রমিক নিতে হয়েছে বলে জানান শৌকত আকবর।
“প্রথম রিঅ্যাক্টর ইউনিটের সব যন্ত্রপাতিই এ বছর চলে আসবে। আগামী বছর দ্বিতীয় বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কাজ আর ইন্সটলেশন শেষ হবে।”
১৯৬১ সালে পদ্মার তীরে পাবনার রূপপুরে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা প্রকল্পের চেহারা নিতে অর্ধশতক পার হয়ে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ প্রকল্পে গতি আসে; চুক্তি হয় রাশিয়ার সঙ্গে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের অক্টোবরে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিস্থাপন করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর রোসাটমের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশন।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড ব্যয়ের এই প্রকল্পে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, মহামারীতে অবরুদ্ধ অবস্থার সময় পরিবহন ও আমদানির ক্ষেত্রে ‘কিছু সমস্যা’ হলেও কাজের ক্ষেত্রে তা বড় ‘প্রভাব ফেলেনি’।
এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মীদের আবাসনের জন্য গণপূর্ত বিভাগ যে গ্রিন সিটি প্রকল্প করছে, সে কাজ সময়মত শেষ করার জন্য মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
শৌকত বলেন, “সময়মত বিদ্যুতের গ্রিড লাইন ও আবাসান হয়ে গেলে কোনো সমস্যা হবে না।”