রিজার্ভ থেকে ঋণ: কোন পথে, ঝুঁকি কী

কয়েক বছর পর আবার আলোচনায় এসেছে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 July 2020, 12:48 PM
Updated : 8 July 2020, 03:00 PM

করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্ব অর্থনীতির দুর্দশার মধ্যে এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক কথায়।

তার কথায় বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে প্রক্রিয়া খুঁজতে শুরু করেছেন, কীভাবে রিজার্ভ থেকে ঋণ দেওয়া যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সার্বভৌম সম্পদ তহবিল গঠন করে রিজার্ভ থেকে ঋণ দেওয়া যেতে পারে। তবে রিজার্ভ খরচ এবং ঋণের প্রকল্প নির্বাচন দুই ক্ষেত্রেই সতর্ক থাকতে হবে।

রপ্তানি, রেমিটেন্স, বিদেশি বিনিয়োগে কোনো দেশে যে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত তৈরি হয়, তা্ই রিজার্ভ, যে ভাণ্ডার থেকে আমদানি ব্যয় মেটানো হয়।

আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, সাধারণত কোনো দেশের তিন মাসের বৈদেশিক মুদ্রার দায় মেটানোর মতো মজুদ থাকতে হয়। এর কম থাকলে ঝুঁকি হিসেবে গণ্য করা হয়।

বাংলাদেশে গত এক দশকে রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে এখন ৩৫ বিলিয়ন (৩ হাজার ৫০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের প্রায় এক বছরের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

নানা টানাপোড়েনে পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন নানা আসার পর এর বিশাল নির্মাণ ব্যয় মেটাতে ২০১৫ সালে রিজার্ভ থেকে ঋণ নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল।

তখন কিছু প্রক্রিয়া শুরু হলেও ২০১৬ সালের মার্চে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ডলার চুরি হওয়ার পর সেই কার্যক্রমে ভাটা পড়ে।

বিশাল অঙ্কের রিজার্ভ অলস বসিয়ে না রেখে তা বিনিয়োগে আনার কথা অর্থনীতিবিদরা বরাবরই বলে আসছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রিজার্ভের অনেকটাই অলস পড়ে থাকে। পাঁচ-ছয় মাসের আমদানি খরচ মেটানোর অর্থ রেখে সরকার চাইলে বাকিটা উন্নয়ন কাজে খরচ করতে পারে।”

এই সভায়ই রিজার্ভ থেকে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব তুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

গত সোমবার একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী রিজার্ভ থেকে ঋণের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন বলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান পরে সাংবাদিকদের জানান।

মান্নান বলেন, “বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা বিদেশিদের কাছ থেকে ডলারে ঋণ নিই। আমাদের রিজার্ভ এখন ৩৬ বিলিয়ন ডলার। এখান থেকে আমরা ঋণ নিতে পারি কি না? বাংলাদেশ ব্যাংক জনগণের পক্ষে এই টাকা সংরক্ষণ করে। ওখান থেকে আমরা প্রকল্পের জন্য ঋণ নিতে পারি। বিদেশ থেকে আমরা যে সুদে ঋণ আনি তা একটু কম হলেও দেশের টাকা ব্যবহার করলে লাভটা দেশেই থাকবে।”

বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলেন সরকার প্রধান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যদি আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের প্রস্তাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসে, তাহলে তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রিজার্ভ থেকে ঋণ নিয়ে কীভাবে উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা যায়, তার একটা সুন্দর পথ খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।”

পথ ‘সভরেন ফান্ড’

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার থেকে ঋণ দেওয়ার জন্য ‘সভরেন ওয়েলথ ফান্ড (এসডব্লিউএফ) বা সার্বভৌম সম্পদ তহবিল’ গঠনই একমাত্র পথ বলে মনে করছেন আহসান এইচ মনসুর।

দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) কাজ করে আসা এই গবেষক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে একটাই পথ আছে। আর সেটা হচ্ছে, এসডব্লিউএফ গঠন করা।

“রিজার্ভ থেকে পাঁচ-সাত বিলিয়ন ডলার নিয়ে এই তহবিল গঠন করা যেতে পারে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা পূরণে এ তহবিলের অর্থ খরচ করবে সরকার। এর বাইরে অন্য কোনো পথ নেই।”

পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সার্বভৌম সম্পদ তহবিল গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাই, তহবিলের কার্যপদ্ধতি এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এর সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার দিকগুলো পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তখনকার ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী নেতৃত্বাধীন ওই কমিটিতেও সদস্য ছিলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর। ওই সময়কার অর্থ সচিব ও বর্তমানে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীও সদস্য ছিলেন কমিটিতে।

আহসান মনসুর

আহসান মনসুর বলেন, “তখন আমরা আমরা ৫ বিলিয়ন ডলারের সভরেন ওয়েলথ ফান্ড গঠনের সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু সেটা কেন করা হল না, বুঝতে পারলাম না।

“তখন রিজার্ভ ছিল ৩২ বিলিয়ন ডলার। এখন ৩৬ বিলিয়ন ডলার। এখন এসডব্লিউএফ গঠন করা যেতেই পারে।”

ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সাধারণত মূলত খনিজ সম্পদ এবং উদ্বৃত্ত বাজেটসমৃদ্ধ দেশই এই সার্বভৌম সম্পদ তহবিল গঠন করে। কারণ তাদের উদ্বৃত্ত বাজেট হয়। বর্তমানে প্রায় ৪৬টি দেশে এ ধরনের তহবিল আছে।

বাংলাদেশে এ তহবিল গঠনের বিষয়ে কমিটি বলেছিল, বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ রপ্তানিকারক দেশ নয়। সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানি, প্রবাসীদের প্রেরিত আয়, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক মুদ্রায় নিট ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এ কারণে উদ্বৃত্ত রিজার্ভ সৃষ্টি হয়েছে এবং যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

কমিটির সুপারিশে বলা হয়, “বাংলাদেশের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে সাত মাসের অধিক সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

“এ অবস্থা বিবেচনায় ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর পর রিজার্ভের বাকি অর্থ দিয়ে সরকার এসডব্লিউএফ করতে পারে। তাতে উদ্বৃত্ত রিজার্ভের আকার দাঁড়াবে প্রায় ৪-৫ বিলিয়ন ডলার।”

সতর্কতার দুই ক্ষেত্র

রিজার্ভ এখন বেশি থাকলেও তা খরচ করার ক্ষেত্রে যেমন সাবধানী হতে বলছেন গবেষকরা; তেমনি বলছেন, ঋণের জন্য প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে লাভালাভের দিকে দৃষ্টি রাখতে।

২০১৫ সালের কমিটি বলেছিল, কেবল সরকারের মেগা প্রকল্পে বা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্প বাস্তবায়নে এ তহবিল থেকে অর্থায়ন করা যেতে পারে। তবে পিপিপি প্রকল্পের ভিজিএফ (ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাইন্যান্সিং) অর্থায়নে এ তহবিল ব্যবহার করা যাবে না। তহবিলের অর্থায়নে প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রকল্পের মেয়াদ যাতে দীর্ঘ হয় এবং পুরো সময়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে মুনাফা পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

“যতই উচ্চ সামাজিক সুবিধাসম্পন্ন প্রকল্প হোক না কেন, কোনোভাবেই সামাজিক অবকাঠামো খাতে এ তহবিলের অর্থ ব্যয় করা উচিত হবে না,” বলা হয়েছিল সুপারিশে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “রিজার্ভের অর্থ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। কোনোভাবেই যাতে অপচয় না হয়, তা দেখেই প্রকল্প নির্বাচন করতে হবে।

“এজন্য এমন প্রকল্প নির্বাচন করতে হবে, যার সুশাসন সর্বোচ্চ মাত্রায় নিশ্চিত হবে, দীর্ঘমেয়াদি হবে এবং নিশ্চিতভাবেই মুনাফা আসবে। মোট কথা তহবিলের অর্থ ফেরত পাওয়াটা যে কোনোভাবেই হোক, নিশ্চিত করতে হবে।”

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলছেন, মহামারীকালে এখন আমদানি ব্যয় কম মেটাতে হলেও কিছু দিন পর পরিস্থিতি বদলেও যেতে পারে, তা্ও ভাবতে হবে।

“৩৫/৩৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কিন্তু খুব বেশি নয়। এখন আমদানি খাতে কম খরচ হচ্ছে ঠিক। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমদানি ব্যয় বাড়বে, তখন এই রিজার্ভ খুবই মূল্যবান হয়ে উঠবে।”

গত ২ জুলাই দেশের রিজার্ভ ইতিহাসে প্রথম ৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। তবে মঙ্গলবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মাসের ৭২ কোটি ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর তা ৩৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

আহসান মনসুর সরকারকে রাজস্ব আয় বাড়াতে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, “এই মহামারীকালে সরকারের রিজার্ভ দরকার নেই, দরকার রাজস্ব (টাকা)। রিজার্ভের অর্থ দিয়ে আমদানি বিল এবং উন্নয়ন প্রকল্পের বিদেশি পেমেন্ট যেটা, সেটা হয়ত পরিশোধ করা যাবে। কিন্তু অন্যান্য খরচের জন্য তো টাকা লাগবে। সরকারকে সেদিকেই বেশি মনোযোগী হতে হবে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে জোর দিতে হবে।”