এক মাসে রপ্তানি বেড়েছে ৮৫%

করোনাভাইরাস মহামারীতে বাংলাদেশের রপ্তানি নেমেছিল তলানিতে, তাতে থেকে উঠতে থাকলেও রপ্তানিকারকরা আশাবাদী হতে পারছেন না।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 July 2020, 03:59 PM
Updated : 6 July 2020, 05:54 AM

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর রোববার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত জুন মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ২৭১ কোটি ৪৯ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক মে মাসের চেয়ে ৮৫ শতাংশ বেশি।

কোভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কা বাংলাদেশে লাগতে শুরু করে গত মার্চ মাস থেকে, এপ্রিলে রপ্তানি কমে মাত্র ৫২ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল, যা ছিল রেমিটেন্সের চেয়েও কম।

বিধিনিষেধ শিথিল করে কলকারখানা চালুর পর মে মাসে রপ্তানি বেড়ে ১৪৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। অর্থবছরের শেষ মাস জুনে তা আরও বাড়ল।

সবমিলিয়ে গোটা ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ৪০ লাখ (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে।

এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে কম ২৬ শতাংশ।

গত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্য ছিল ৩৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে তৈরি পোশাক থেকে আয় হয়েছিল ৩৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার।

এ হিসাবে গত অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে এ খাতে আয় কমেছে ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

২০১৯-২০ অর্থবছরে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের চেয়ে আয় কমেছে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

উভেন পোশাক থেকে আয় হয়েছে ১৪ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আনা বন্ধ হয়ে যায়।

ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাতে ফেব্রুয়ারি থেকেই প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল। এরপর শুরু হয় ক্রয়াদেশ বাতিলের হিড়িক। মার্চ মাসে এসে রাপ্তানির অঙ্কে ধস স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ওই মাসে ২২৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা আগের বছরের মার্চের চেয়ে ২০ শতাংশ কম ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) মধ্যে সেটিই ছিল বড় ধাক্কা।

ইপিবি’র তথ্যে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছিল ৮৫ শতাংশ। মে মাসে কমে ৬১ শতাংশ। আর সর্বশেষ জুনে কমেছে ২ ৫ শতাংশ।

জুন মাসে রপ্তানি হয়েছে ২৭১ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের পণ্য। লক্ষ্য ছিল ৩৯৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয় হয়েছিল ২৭৮ কোটি ৪৪ লাখ ডলার।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এপ্রিল মাসের পুরোটা সময় পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতিও ছিল খুব খারাপ। সে কারণে এপ্রিলে রপ্তানি তলানিতে নেমে এসেছিল।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে মূল ভূমিকা থাকে তৈরি পোশাক শিল্পের; মে মাসে পোশাক কারখানাগুলোতে উৎপাদন হয়েছে। আগের ‘অর্ডার’ও ছিল। ইউরোপের দেশগুলোর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় রপ্তানিও কিছুটা বেড়েছে।

তবে নতুন ‘অর্ডার’ না আসার পাশাপাশি অনেক ক্রেতা ‘অর্ডার’ বাতিল করেছে বলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন।

ফলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কা জানিয়েছেন পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন নতুন করে কোনো অর্ডার আসছে না। আগের যে অর্ডার ছিল সেগুলোও অনেকে বাতিল করছেন। খুবই কঠিন সময় পার করছি আমরা। খুব সহসা এই সঙ্কট কাটবে বলেও মনে হয় না।”

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বলছে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বিশ্বে পোশাকের চাহিদা ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে যাবে।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের ৪০ লাখ শ্রমিকের জীবিকাও রয়েছে অনিশ্চয়তায়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

রুবানা বলেন, “জুন মাসের যে রপ্তানি সেটা কিন্তু কোভিড-১৯ এর আগের অর্ডারের। নতুন অর্ডার না আসলে রপ্তানি হবে কীভাবে? তাই সামনের দিনগুলো নিয়ে খুবই শঙ্কিত আমরা।”

এ পরিস্থিতিতে রপ্তানি খাতের জন্য মার্কিন ডলারের বিনিময় হার পাঁচ টাকা বেশি, ছোট কারখানাগুলোর জন্য কম সুদে ঋণের ব্যবস্থাসহ সরকারের কাছে নীতি সহায়তা চেয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি।

নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এপ্রিলের-মে মাসের চেয়ে জুনে রপ্তানি বৃদ্ধি একটি পজিটিভ দিক। তবে এতে যে সঙ্কট কেটে যাচ্ছে সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

“আমাদের হাতে অর্ডার নেই। আগামী মাসগুলোতে কী রপ্তানি করবো? সে কারণে আমরা কিছুই বলতি পারছি তা আমাদের ভবিষৎ কী?”

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি আয় এমনিতে ভালো হচ্ছিল না, এখন তাতে যুক্ত হয়েছে মহামারীর প্রভাব।

 পরিস্থিতি ভালো ছিল না। নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল প্রতি মাসেই।

“কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তা কেউ বলতে পারে না। আর পরিস্থিতি ভালো হলেই যে মানুষ আগের মতো পোশাক কিনবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

ফলে সঙ্কট কেটে যাওয়ার আশু ইঙ্গিত দেখছেন অর্থনীতির এই বিশ্লেষক।

পাট থেকে আয় বেড়েছে

এই সঙ্কটেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।

নৌকা থেকে মাথায় করে ঘিওর হাটে পাট তুলছেন শ্রমিক। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

গত অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় করেছে।

এই অঙ্ক ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ৭ শতাংশ।

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের নয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ পর্যন্ত পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে ২৫ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি ছিল।

মহামারীকালে ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ।

বাকি অন্য সব খাতেই কমেছে। চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি কমেছে ১৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি ৮২ লাখ (৪০.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। তাতে প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছিল ৪ শতাংশ।

২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৪ হাজার ৫৫০ কোটি (৪৫.৫০ বিলিয়ন) ডলার।