চীন থেকে মুখ ফেরানো বিনিয়োগ ধরতে নিয়ম সহজ করার উদ্যোগ

করোনাভাইরাস মহামারী এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে চীন থেকে সেরে যাওয়া বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নিয়মকানুন সহজ করার পাশাপাশি ব্যাংকিং জটিলতা কমাতে বলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 June 2020, 07:19 AM
Updated : 26 June 2020, 07:19 AM

মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিবের কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, “বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যাতে অনায়াসে বিনিয়োগের অর্থ-লভ্যাংশ নিজ দেশ বা অন্যত্র নিয়ে যেতে পারেন, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা কর্তৃক জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকিং কার্যক্রমে নিয়মনীতি সহজীকরণ বা যুগোপযোগী করতে হবে।”

‘কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিকরণ’ শীর্ষক ওই চিঠিতে বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলা হয়েছে, “চীন থেকে অনেক বিদেশি বিনিয়োগ বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান অন্যত্র স্থানান্তরের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এ অঞ্চলের অনেক দেশ, যেমন ভারত, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া এ ধরনের বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে নিজ নিজ দেশের বিনিয়োগ সংক্রান্ত আইন, বিধিবিধান, কর-ব্যবস্থা এবং ব্যাংকিং পদ্ধতি সহজতর করছে।”

এসব দেশে আইনি কাঠামো, নীতিসহায়তায়, ব্যাংকিং নীতি ও পদ্ধতিতে প্রযুক্তির ব্যবহারসহ ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারও এসব বিনিয়োগ দেশে আনতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংককেও কিছু নিয়ম সহজ করতে হবে।

“বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যাতে অর্থ-লভ্যাংশ নির্বিঘ্নে নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারেন, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত ৮ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে ‘সর্বোত্তম ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করার ওপরও প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব আরোপ করেন।”

চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের শ্রমবাজার সহজলভ্য। রাজনৈতিক অবস্থাও স্থিতিশীল। প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের শিল্প, কৃষি এবং সেবা খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী। আমানতের সুদের হার বিদেশি ব্যাংকের তুলনায় বেশি হওয়ায় দেশীয় ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিমে তারা বিনিয়োগে উৎসাহিত হচ্ছেন।

“কিন্তু অনেক সময় সঞ্চয় স্কিমের মেয়াদ শেষে অর্থ উত্তোলন এবং প্রবাসে অর্থ প্রত্যাবাসনের সময় তারা ব্যাংকের জটিল প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হন, যা অনেক প্রবাসীকে দেশে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করে।”

বিদ্যমান ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট যুগোপযোগী করার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি একটি খসড়া তৈরি করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এ আইনে আর কী কী পরিবর্তন আনা দরকার, সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করে দ্রুততম সময়ে আইনটি পাস করার ওপর জোর দেওয়া হয় চিঠিতে।

বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ‘যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে’, তা কাজে লাগাতে ব্যাংকিং কার্যক্রম পর্যালোচনা করে বিদ্যমান আইনগত, নীতিগত এবং পদ্ধতিগত প্রতিবদ্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছে অর্থমন্ত্রণালয়।

গত ১৭ জুন প্রকাশিত জাতিসংঘের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংস্থা আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ১৫৯ কোটি ৭০ লাখ (১.৫৯ বিলিয়ন) ডলার। এই অঙ্ক গত ৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

আগের বছর ২০১৮ সালে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ৩৬১ কোটি ৩০ লাখ (৩.৬১ বিলিয়ন) ডলার। সেটা ছিল এক বছরে আসা সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ।

এর মধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১.৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল ওই জাপানি কোম্পানি।

এখন কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এলোমেলো হয়ে পড়া বিশ্ব অর্থনীতিতে ২০২০ সালে এফডিআই আরও কমবে এবং তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে বলে আভাস দিয়েছে আঙ্কটাড।

বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের সংগঠন অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে বলেন, “বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ব্র্যান্ডিং। যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, ব্র্যান্ডিং করতে না পারলে এফডিআই আসবে না।

“বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে আমরা এখনও আমাদের ব্র্যান্ডিং যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এছাড়া আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এতদিনেও আমরা আমাদের বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি। এটা খুবই দুখঃজনক।

তিনি বলেন, “গ্রামীণফোনের নিরীক্ষা আপত্তির টাকা নিয়ে বিটিআরসির সঙ্গে জটিলতা বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশ সম্পর্কে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাজে সংকেত দিয়েছে।”

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ অর্থনীতির আকারের বিবেচনায় অনেক কম। অবকাঠামোর ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক কূটনীতির অভাবই এর মূল কারণ বলে মনে করেন এরশাদ আহমেদ।

তিনি বলেন, “বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলো সরকার বাস্তবায়ন করছে বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে। এসব প্রকল্প পিপিপির আওতায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমেও হতে পারত। সেক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ত।”