পর্যটনে মহামারীর ধাক্কায় বেকার হওয়ার ঝুঁকিতে ‘৪০ লাখ’

করোনাভাইরাস মহামারীতে সাধারণ ছুটি কাটিয়ে দেশে চলাচল ও জীবিকায় কিছুটা গতি ফিরলেও পর্যটন শিল্পে যুক্তদের চোখে এখনও অন্ধকার।

গোলাম মুজতবা ধ্রুব নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 June 2020, 03:45 PM
Updated : 21 June 2020, 03:54 PM

বৈশ্বিক মহামারীর প্রভাবে পর্যটন খাতকে ঘিরে দেশে জীবিকা নির্বাহ করা লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বেন বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

এই সংখ্যাটি কত- জানতে চাইলে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিওএবি) সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান বলেন, ৪০ লাখের মতো।

এই শিল্পে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রচুর মানুষ যুক্ত বলে মোট কর্মরতদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই কোথাও।

ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্সি, হোটেল-মোটেল ছাড়াও পর্যটন স্থানকেন্দ্রিক নানা ব্যবসায় যুক্ত এই মানুষদের সামনে ঘোর অনিশ্চয়তা।

বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ, ইমিগ্রেশন পুলিশ ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে প্রায় আট থেকে ১০ লাখ বিদেশি পর্যটক ঘুরতে আসেন বাংলাদেশে। আর দেশের অভ্যন্তরে এক কোটির বেশি মানুষ পর্যটক হিসেবে বিভিন্ন গন্তব্যে ভ্রমণ করেন।

তবে এবার করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে তাতে দেখা দিয়েছে ছন্দপতন।

চীন থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে পর্যটনের ভরা মৌসুমে বিদেশিদের আসা হয়েছে কম। এরপর মার্চে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে পর্যটন কেন্দ্রগুলো রয়েছে বন্ধ।

বিভিন্ন দেশে লকডাউন শুরুর পর বিশ্বে পর্যটকের সংখ্যাও কীভাবে নেমে এসেছে, তা দেখালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া। 

তিনি বলেন, ২০২০ সালের শুরুটা পর্যটন শিল্পের জন্য ‘ভালোই ছিল’।

বান্দরবান নীলাচলে পাহাড়ে একটি রিসোর্ট, যা এখন বন্ধ

“বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে পর্যটকের সংখ্যা বিগত বছরের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি ছিল। তবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ব্যাপক নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে।” 

বিশ্ব পর্যটন সংস্থার ওই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি জানান, ফেব্রুয়ারি মাসে আগের মাসের মাসের তুলনায় ৯ শতাংশ এবং মার্চ মাসে ৫৭ শতাংশ পর্যটকের আগমন কম হয়েছে।

বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প একটি উদীয়মান শিল্প এবং কয়েক বছরে পর্যটন শিল্পের চোখে পড়ার মতো উন্নতি হলেও করোনাভাইরাসের মহামারীতে তাতে ধস দেখছেন ড. বদরুজ্জামান । 

“সব ধরনের হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে।”

প্যাসিফিক এশিয়া  ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনের বরাতে তিনি বলেন, জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত মোট পাঁচ মাসে সার্বিক পর্যটন শিল্পে ৯ হাজার ৭০৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে প্রায় ৩ লাখ ৯ হাজার ৫০০ জন চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে।

“হোটেল-রিসোর্ট এবং রেস্তোরাঁয় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি এবং কর্মহীন প্রায় আড়াই লাখ মানুষ। ট্রাভেল এজেন্সিতে ৩ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি এবং কর্মহীন প্রায় ১৫ হাজার মানুষ।”

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন ট্যুর অপারেশনে ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকার (ইনবাউন্ড, আউটবাউন্ড ও ডমেস্টিক) ক্ষতি এবং ৪১ হাজার মানুষ কর্মহীন হতে পারে।

এছাড়া পর্যটন পরিবহন ও পর্যটকবাহী জাহাজে ৫৫ কোটি টাকার ক্ষতির পাশাপাশি এখানে প্রায় দেড় হাজার মানুষ কর্মহীন হতে পারেন।

এর বাইরে পর্যটন স্থানকেন্দ্রিক নানা ব্যবসায় যুক্ত মানুষদের নিয়ে এ শিল্পে যুক্ত মানুষের সংখ্যা‘আনুমানিক ৪০ থেকে ৪৫ লাখ’ বলে ধারণা দেন ড. বদিউজ্জামান।

মৌলভীবাজারের গ্র্যান্ড সুলতান হোটেল

“আমাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৪০ লাখ লোক জড়িত,” বলেন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান।

মহামারীকালে এখন টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা কোনো কাজ করতে পারছি না। গত এক বছরে আমাদের প্রায় ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমরা কোনোমতে বেঁচে আছি।”

করোনাভাইরাসের এই মহামারী কবে শেষ হবে, তার কোনো আভাস নেই কোথাও। পরিস্থিতির কবে উন্নতি হবে, কবে পর্যটকরা আবার নিঃসংশয়ে বের হবেন, তারও কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে টোয়াব মহাসচিব মো. মাজহারুল এইচ ভূঁইয়া বলেন, “যতদিন মানুষের ভ্রমণের প্রতি আস্থা তৈরি না হচ্ছে ততদিন আমরা কাজ করতে পারছি না।

“এটাই স্বাভাবিক। কারণ মানুষের মনে আগে আস্থা থাকতে হবে যে ভ্রমণ করলে তারা আক্রান্ত হবেন না। তারপরই তারা ভ্রমণ করবেন।”

এই পরিস্থিতিতে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পেতে চান ট্রাভেল এজেন্টরা।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপ্লোরারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিইএ) পক্ষ থেকেও সঙ্কট মোকাবেলায় পর্যটন শিল্পে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার দাবি করা হচ্ছে।

দিশাহীন হোটেল-মোটেল বাণিজ্য

সিলেটের প্রায় ২শ হোটেল-মোটেলে প্রতিদিন ২ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে বলে দাবি করছেন সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু তাহের মো. সোয়েব।

“এই চার মাসে ব্যবসায়ীদের সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে।”  

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, “মার্চের পর থেকেই এখানে অন্তত ছোট-বড় মিলিয়ে দেড় শতাধিক হোটেল-মোটেল বন্ধ রয়েছে। এতে এই তিন মাসে অন্তত ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।”

সংশ্লিষ্টরা আরো বলছেন, এই অঞ্চলে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ২০ থেকে ২৫টি খাতে সব মিলিয়ে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে এসব হোটেল চালু করা যায়, তা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা চলছে জানিয়ে মোতালেব শরীফ বলেন, “কাজ শুরু না হলে আমাদের বেঁচে থাকার কোনো উপায় থাকবে না।”

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে সামান্য দূরেই ভিস্তা বে হোটেল। আগে এখানে পর্যটকের সমাগম থাকলেও গত কয়েক মাসে পরিস্থিতি বদলে গেছে; হোটেলে কোনো অতিথি আসছেন না এখন।

এই হোটেলের অপারেশন ম্যানেজার মো. আউয়াল খান শান্ত বলেন, “করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের অবস্থা খারাপ। আমরা একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছি।”

ঢাকা থেকে অনলাইনে ট্যুর পরিচালনা করে থাকে বেঙ্গল ট্রেকার্স। অনলাইনে দল গঠন করে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, সেইন্ট মার্টিনসহ বিভিন্ন জায়গায় ট্যুর পরিচালনা করতেন তারা।

এই প্রতিষ্ঠানের সিইও মো. আরাফাত হোসেন বলেন, “আমাদের সাথে অনেকেই জড়িত রয়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির মধ্যে আমরা কোনো ধরনের ট্যুর প্লান করতে পারছি না।”

কী বলছে কর্তৃপক্ষ

মহামারী পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটে মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলে বন্ধ হোটেল-মোটেল খুলে দেওয়া হবে বলে জানালেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মহিবুল হক।

এর আগে এসব খুলে দিলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন,  “আমরা হোটেল-মোটেল খুলে দেওয়ার জন্য এরই মধ্যে সভা করেছি। সেগুলো খুললে কী হবে সেটা নিয়ে আলোচনা করেছি।”

ট্রাভেল এজেন্ট ও ট্যুর অপারেটরদের প্রণোদনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আর্থিক বিষয়টা নিয়ে আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু আমরা এখনও কোনো ফলাফলে পৌঁছাতে পারিনি।

“তাদের কীভাবে প্রণোদনা দেব, সেটা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারিনি। আবারও এটা নিয়ে বসব।”

প্রণোদনার আর্থিক সুবিধা নেওয়ার নিয়ম উল্লেখ করে মহিবুল বলেন, “ব্যাংক তাদের বলেছে সাড়ে ৪ শতাংশ ইন্টারেস্টে তারা প্রণোদনার টাকা নিতে পারবে।

“তারা যদি এভাবে নিতে চায় তাহলে তো তাদেরকে সিকিউরিটি দিয়ে নিতে হবে, মর্টগেজ দিয়ে নিতে হবে। তারা মর্টগেজ ছাড়া নিতে চাইছে, সেটা তো সম্ভব না।”