‘কালো’ টাকা: বিনিয়োগে আসে না, তবু বারবার সুযোগ

মহামারীকালের বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার ঢালাও সুযোগ দিয়ে পুরনো সেই সমালোচনা ফিরিয়ে এনেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 June 2020, 11:32 AM
Updated : 15 June 2020, 03:19 AM

অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ এবং ২০০৮ সাল ছাড়া ‘কালো টাকা সাদা করার’ সুযোগ দিয়ে তেমন সুফল মেলেনি। তারপরও বারবার এই সুযোগ দেওয়ায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

১০ শতাংশ কর দিয়ে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনা, দালান নির্মাণ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ গত অর্থবছরেই ছিল।

২০২০-২১ সালের বাজেটে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজের ক্ষেত্রেও একই সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

কোনো জরিমানা ছাড়া কেবল ১০ শতাংশ কর দিয়ে যে কেউ তার অবৈধভাবে অর্জিত অথবা কর ফাঁকি দিয়ে গোপনে সঞ্চিত অর্থ এসব খাতে বিনিয়োগ করতে পারবেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বা সরকারের অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ ওই টাকার উৎস জানতে চাইবে না।

অবৈধ টাকার মালিকদের জন্য একে ‘সুবর্ণ সুযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে কখনও এমন সুযোগ দেওয়া হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। ঘুষ-দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতি করে বালিশের নিচে যারা টাকা রেখে দেন, তারাও ওই টাকা বৈধ করতে পারবেন।”

এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় সব সরকারই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। এ পর্যন্ত দেশে ১৫ অর্থবছরে এ সুযোগ দিয়ে সব মিলিয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা ‘সাদা’ হয়েছে। আর তা থেকে সরকার কর পেয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা মত।

সবচেয়ে বেশি অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগে এসেছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, যখন দেশের পরিস্থিতি ছিল একেবারেই ভিন্ন।

ওই দুই বছরে ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ সুযোগ নিয়েছিল; বৈধ হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। তা থেকে সরকার কর পেয়েছিল এক হাজার ২০০ কোটি টাকার কিছু বেশি।

এর মধ্যে ২০০৭ সালে ৮০৩ কোটি টাকা এবং পরের বছর ৪০০ কোটি টাকা কর পেয়েছিল এনবিআর।

এই হিসাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগে যে পরিমাণ অপ্রদর্শিত আয় বৈধ হয়েছে, তার ৬৪ দশমিক ২৪ শতাংশই হয়েছে ওই দুই বছরে। এ পর্যন্ত পাওয়া মোট করের ৮০ শতাংশও ওই দুই বছরে এসেছে।

বাংলাদেশে কত টাকা ‘অপ্রদর্শিত’, অর্থাৎ আয়কর বিবরণীর ঘোষিত আয়ের বাইরে রয়ে গেছে- তা নিয়ে সাম্প্রতিক কোনো গবেষণা নেই৷

বিশ্ব ব্যাংক ২০০৫ সালের এক গবেষণায় বলেছিল, ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিল মোট জিডিপির ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ।

২০১১ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় কালো টাকা নিয়ে একটি জরিপ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ২০১০ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিলো জিডিপির ৭ শতাংশ৷ আর ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

বাংলাদেশে অবৈধ আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে মাদক চোরাকারবার, অবৈধ বাণিজ্য, ঘুষ ও দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছিল বিশ্ব ব্যাংক।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ‘কালো টাকা’ একটি ‘ওপেন সিক্রেটে’ পরিণত হয়েছে। ছোট চাকরি করলেও অনেকে বিলাসী জীবনযাপন করেন; ছেলে-মেয়েদের ব্যয়বহুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ান, বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকেন, দামি গাড়ি চালান। ঘুষ-দুর্নীতিসহ অবৈধভাবে উপার্জন করা অর্থসম্পদ নামে–বেনামে নানা পন্থায় লুকিয়ে রাখেন তারা।

সেই টাকা অর্থনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকার ‘সাদা’ করার সুযোগ দেয়। কখনো ঢালাও সুযোগ, কখনো শর্ত সাপেক্ষে সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারের দেওয়া সেই সুযোগ খুব বেশি কাজে লাগান না কালো টাকার মালিকেরা।

অর্থমন্ত্রী এবার এক বছরের জন্য যে ঢালাও সুযোগ দিয়েছেন, তাতে কারও কাছে নগদ টাকা থাকলেও তা সাদা করা যাবে। ব্যাংকে থাকা টাকার পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা টাকাও ঘোষণায় আনা যাবে। শুধু বার্ষিক আয়কর বিবরণীতে ওই টাকা প্রদর্শন করে ১০ শতাংশ কর দিলেই চলবে।

কেউ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো শেয়ারে অপ্রদর্শিত আয়ের টাকা বিনিয়োগ করতে চাইলে তা কমপক্ষে তিন বছরের জন্য করতে হবে। তিন বছরের ‘লক ইন’ বা বিক্রয় নিষেধাজ্ঞার শর্তে এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

এত দিন ফ্ল্যাট কেনায় এই সুযোগ ছিল। এখন নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে জমি কেনাতেও এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি মনে করি, ঢালাওভাবে এ সুযোগ দেওয়া ঠিক হয়নি। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, কালো টাকার সুযোগ অবারিত করেও কোনো সুফল আসেনি। উল্টো সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, প্রতি বছর আন্ডার ইনভয়েসিং-ওভার ইনভয়েসিংসহ নানাভাবে ‘প্রচুর টাকা’ দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে যায় এবং সরকারও বিষয়টি জানে।

“এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে করেই হোক এটা দ্রুত বন্ধ করতে হবে। সেজন্য অর্থ পাচার রোধে আরও কঠোর আইন করা দরকার।”

বৃহস্পতিবার সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল তার বক্তৃতায় বলেন, দেশ থেকে আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং এবং ভুয়া বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

এ ধরনের প্রবণতা রোধ করতে যে পরিমাণ অর্থ আন্ডার ইনভয়েসিং বা ওভার ইনভয়েসিং করে পাচার করা হয়েছে এবং যে পরিমাণ প্রদর্শিত বিনিয়োগ ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হবে, তার ওপর ৫০ শতাংশ হারে করারোপ করার প্রস্তাব করেন তিনি।

শুক্রবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের টাকা অবৈধভাবে যারা বিদেশে বিনিয়োগ করছেন, তাদের ধরতে বিদ্যমান আইনগুলোর ত্রুটি-বিচ্যুতি ঠিক করা দরকার।

“আমরা চাই আমাদের দেশের অর্থ বিদেশে না যাক। এদেশের অর্থ এখানে অর্জন করে এখানে খরচ করতে হবে। আর যারা খরচ করতে চান না, এখান থেকে তারা একবারেই চলে যাক না।”

ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস সঙ্কটকে যুক্তি হিসেবে দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তার ভাষায়, এটা ‘বিশেষ পরিস্থিতি’, সেজন্য ‘বিশেষ উদ্যোগ’ দরকার।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে সৎ করদাতাদের প্রতি একধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়।

তিনি বলেন, একজন করদাতা বৈধভাবে ২০ লাখ টাকার করযোগ্য আয় করলে তাকে সব মিলিয়ে প্রায় ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা কর দিতে হয়। আর একজন ব্যক্তি যদি দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত ২০ লাখ টাকা সরকারের দেওয়া এই বিশেষ সুযোগে সাদা করেন, তাহলে তার ২ লাখ টাকা কর দিলেই হবে।

“এমন যদি অবস্থা হয়, তাহলে সৎ করদাতারাও এখন কর না দিয়ে বসে থাকবে। সেটা সরকারের জন্য বিপদ হবে, ট্যাক্স কম পাবে।”

আবদুল মজিদ বলেন, “আমি মনে করি, এখনই একটি ঘোষণা দেওয়া উচিৎ যে, যারা সরকারের দেওয়া সুযোগ নিয়ে কালো টাকা সাদা করবে না, তাদের বিরুদ্ধে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর অভিযান চালাবে এনবিআর। যাদের কাছে কালো টাকা পাওয়া যাবে, সেই টাকা জব্দ করাসহ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

২০০৭ ও ২০০৮ সালের প্রসঙ্গ টেনে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, “ওই সময় ছিল ভিন্ন পেক্ষাপট। রাস্তায় টাকার বস্তা-দামি দামি গাড়ি পড়ে থাকত। অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শন না করলে বড় বিপদ হবে-এই ভয়ে অনেকে টাকা সাদা করেছিল।”

অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের অনেকেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিরোধিতা করেন সব সময়।

মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, “আমরা অতীতেও বলেছি, এখনও বলছি, এ ধরনের সুযোগ সৎ করদাতাদের জন্য পুরস্কারের বদলে শাস্তিস্বরূপ। অতীতে এ সুযোগ দিয়ে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়নি। তাই বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ এই সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সরে আসা উচিৎ।”