বাজেট: পরিচালন ব্যয়ের অর্ধেক বেতন-সুদ-পেনশনে

মহামারীর মধ্যে নতুন অর্থবছরের জন্য পৌনে ছয় লাখ কোটি টাকার যে বাজেট অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দিয়েছেন, তার ৬২ শতাংশই খরচ হবে পরিচালন খাতে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 June 2020, 06:36 PM
Updated : 12 June 2020, 06:36 PM

৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকার এই পরিচালন ব্যয় বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি।

আর এই টাকার ৪৫ শতাংশ, এক লাখ ৫৭ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা খরচ হবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশন এবং সুদ মেটাতে।

শেখ হাসিনার টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের দ্বিতীয় বাজেট বৃহস্পতিবার সংসদে পেশ করেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। ৩০ জুন এই বাজেট পাস হবে। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নতুন অর্থবছর।

এমন এক সময়ে এবার বাজেট দিতে হল, যখন বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের মহামারীতে অর্থনীতি পড়েছে নাজুক দশায়। ফলে অর্থমন্ত্রীকে বাজেট সাজাতে গিয়ে মানুষের জীবন-জীবিকা বাঁচানোর পাশাপাশি অর্থনীতির ক্ষত সারানোর কথা মাথায় রাখতে হয়েছে।

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবছর বাড়ে। অন্য অনেক খাতে বরাদ্দ কমানো গেলেও ঋণের সুদ পরিশোধ এবং বেতন-ভাতায় কাঁচি চালানোর সুযোগ থাকে না।

অর্থনীতিতে বাজেটকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় বা পরিচালন বাজেটকে বলে রাজস্ব বাজেট। আর উন্নয়ন বাজেট পরিচিত সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি হিসেবে।

২০২০-২১ অর্থবছরের এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পানা করেছেন। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় বা রাজস্ব বাজেট ৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা।

এই বাজেটের সবচেয়ে বেশি অর্থ ৬৫ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা চলে যাবে সরকারি বেতন-ভাতায়, যা মোট রাজস্ব বাজেটের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।

সুদ পরিশোধে খরচ হবে ৬৩ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা বা ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। আর অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন বাবদ ব্যয় হবে ২৭ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।

বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতায় বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৬০ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৬১ হাজার ১০৯ কোটি টাকা করেছেন অর্থমন্ত্রী।

সুদ পরিশোধে বরাদ্দ ছিল ৫৭ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৬৬৩ কোটি।

পেনশনে মূল বাজেটের ২৭ হাজার ১১৭ কোটি টাকা থেকে কিছুটা কমে ২৭ হাজার ৮৮ কোটি টাকা হয়েছে।

নতুন বাজেটে এ তিন খাতে বেশি অর্থ ব্যয় ধরার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মুনফার হার বেশি হওয়ায় গত কয়েক ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক বেড়েছে। সেই সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে। তাতে এ খাতে ব্যয় বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে দেশি-বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। তার সুদও শোধ করতে হবে।

সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতিবছর ইক্রিমেন্ট হয়; তার পেছনেও ব্যয় বাড়ে। অনেকের পদোন্নতি হওয়ায় বেতন বাড়ে। সে কারণে এ খাতেও সরকারের খরচ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।

মুস্তফা কামাল তার দ্বিতীয় বাজেটে বেতন ও ভাতা বাবদ যে বরাদ্দ রেখেছেন তার মধ্যে ১০ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা কর্মকর্তাদের বেতনে খরচ করবেন। ২৪ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা খরচ করবেন কর্মচারীদের বেতনের জন্য। আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাতার জন্য রেখেছেন ৩০ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা।

সুদ পরিশোধের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য রাখা হয়েছে ৫৮ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য রেখেছেন ৫ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা।

অন্যান্য ব্যয়

সরবরাহ ও সেবা খাতের খরচের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৫ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। মেরামত ও সংরক্ষণ বাবদ নতুন বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার ২৪২ কোটি টাকা।

নতুন বাজেটে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি বাবদ ৩৮ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে । প্রণোদনায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা।

নতুন বাজেটে সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন, সেখানে সামগ্রিক ঘাটতি দেখানো হয়েছে এক লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। ঘাটতির এই পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশের মত।

এই বিশাল ঘাটতি মেটাতে সরকারকে দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা ঋণ নিতে হবে।

অর্থমন্ত্রী পরিকল্পনা করেছেন, এবার বৈদেশিক উৎস থেকে ৮৮ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে। সেখান থেকে ১২ হাজার ৮২০ কোটি টাকা আগের ঋণের কিস্তি পরিশোধে খরচ হবে। ফলে সরকারের নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা।

ঘাটতির বাকি এক লাখ ২ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা, ব্যাংক বহির্ভূত উৎস থেকে নেওয়া হবে ২৫ হাজার ৩ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ২০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৫ হাজার ৩ কোটি টাকা অন্যান্য উৎস থেকে।

বিদায়ী ২০১১৯-২০ অর্থবছরের মূল বাজেটে নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা, সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৫২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এ অর্থবছরের মূল বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭৭ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা নিয়ে ঘাটতি মেটানোর কথা বলা হয়েছিল। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৯৮ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।

বিদায়ী অর্থবছরে মূল বাজেটে ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্য ছিল; সংশোধিত বাজেটে তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৮২ হাজার ৪২১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার লক্ষ্য ছিল। সংশোধিত বাজেটে তা অবশ্য কমে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।

বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছিল এক লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা, সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে এক লাখ ৫০ হাজার ৫৪ কোটি টাকা হয়েছে।