এ গবেষণা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলছেন, সরকার এই মহামারীর সময়ও বাজেট প্রণয়নে গতানুগতিক ধারার বাইরে যেতে পারেনি বলে তাদের মনে হয়েছে।
“আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটি গতানুগতিক একটি বাজেট। কেননা কোভিড থেকে স্বাস্থ্য অর্থনীতি, মানবিক এবং সামাজিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, সেটা একটি নজিরবিহীন সঙ্কট। যাতে বহুমুখী সঙ্কটকে মোকাবিলা করা যায়। এই বাজেটে যথেষ্ট পরিমাণে সৃজনশীল পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা সেই ধরনের প্রাধিকার বা অগ্রাধিকারও দেখতে পাইনি।”
করোনাভাইরাসের মহামারীর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
তার এই পরিকল্পনায় আয় ও ব্যয়ের ঘাটতি থাকছে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৬ শতাংশের মত। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণে ওই ঘাটতি পূরণের আশা করছেন কামাল।
সামনে গভীর অনিশ্চয়তা রেখেই অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, তার নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি ৫.৪ শতাংশের মধ্যে আটকে রেখেই ৮.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হবে।
রেওয়াজ অনুযায়ী বাজেটের পরদিন শুক্রবার বাজেট প্রস্তাবের বিষয়ে সিপিডির পর্যালোচনা তুলে ধরেন ফাহমিদা খাতুন। মহামারীর কারণে এবারের সংবাদ সম্মেলন হয় অনলাইনে।
ফাহমিদা বলেন, “মহামারীর কারণে পৃথিবীর উন্নত অনুন্নত অনেক দেশ অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছে। তারা কিন্তু জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত নয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাস অনুযায়ী পৃথিবীর অনেক বড় প্রবদ্ধির দেশও এখন নেতিবাচক বা অনেক কম প্রবৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে।”
সেখানে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট প্রস্তাবে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ধরেছেন, তাকে ‘অসম্ভব’ হিসেবে বর্ণনা করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, “অর্থনীতি কোথায় যাচ্ছে তাই আমরা জানি না। চলতি অর্থ বছরে যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সেখানে মহামারীর মধ্যেও একই লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে থাকে?”
তিনি বলেন “অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময় এখন নয়। এখন কীভাবে আমরা মহামারী থেকে ক্ষয়ক্ষতিটা প্রশমন করব এবং অর্থনীতি কীভাবে পুনরুদ্ধার করব- সেই চিন্তা করার সময়।”
মহামারীর এই পরিস্থিতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রপ্তানি, আমদানি এবং ব্যক্তি ও সরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য ‘বাস্তবতার আলোকে দেওয়া উচিত ছিল’ বলে মন্তব্য করেন ফাহমিদা।
তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রীর দেওয়া বাজেট বিশ্লেষণ করে তাদের মনে হয়েছে, মধ্য মেয়াদী বাজেট কাঠামোর আওতায় সরকার আগেই অর্থনীতির গতি প্রকৃতি এবং চলকগুলো নির্ধারণ করেছে। সেটা মহামারী আসার আগেই করা হয়েছিল।
“বাজেটে সেগুলো আর পরিবর্তন করতে চাননি। কিন্তু মহামারী আসার পর সামগ্রিক অর্থনীতি পরিবর্তন হয়ে গেছে।”
ফাহমিদা বলেন, মহামারী কবে শেষ হবে কেউ জানে না। ক্ষয়ক্ষতি আর কতটা বাড়বে, সেটাও স্পষ্ট নয়। এমন অবস্থায় বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বাজেট পুনর্বিবেচনা করার প্রয়োজন হতে পারে। আর সেজন্য সরকারের প্রস্তুত থাকা দরকার।
এ ধরনের নজিরবিহীন সংকট মোকাবিলার জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট আরও ‘সৃজনশীল’ হওয়া দরকার ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সরকার এক ধরনের অনুমিতি ব্যবহার করেছে। তারা ভেবেছে এই সঙ্কট থেকে খুব দ্রুতই তারা ফেরত আসতে পারবে।
“সরকার মনে করেছে, এই মহামারীতে যেভাবে হঠাৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অর্থনীতির সূচকগুলো নিচে নেমে গেছে, সেভাবে আবার ওপরের দিকে উঠে যাবে। এই অনুমান ব্যবহার করে সরকার পূনরুদ্ধার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।”
অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষিসহ পাঁচটি খাতে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বললেও তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করছে সিপিডি।
ফাহমিদা বলেন, “সেই প্রাধিকার হিসেবে যে ধরনের অর্থ বরাদ্দ ও কমিটমেন্ট দরকার সেটা আমরা দেখতে পাইনি।”
তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরে যেখানে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ জিডিপির শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ ছিল, সেটা এবার বাড়িয়ে শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ করা হয়েছে। অথচ অনেক অনুন্নত দেশও এ খাতে জিডিপির ১ শতাংশের বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাকেও ‘অবাস্তব’ হিসেবে বর্ণনা করেন ফাহমিদা।
তিনি বলেন, আগামী বাজেটেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা ‘অনৈতিক’, তাতে ভালো করদাতারা নিরুৎসাহিত হবে।
বরং দেশকে কর না দিয়ে যারা কালো টাকার মালিক হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে এনবিআর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলেন তিনি।
তবে ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে একটি সার্বজনীন বীমা স্কিম করার ওপরও জোর দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক।
অন্যদের মধ্যে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানও এই ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।