বাজেট ঘোষণার দিনে রেমিটেন্স চূড়ায়

অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে বাজেট ঘোষণার দিন প্রবাসীদের পাঠনো রেমিটেন্স ১৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 June 2020, 08:35 PM
Updated : 21 June 2020, 04:12 PM

করোনাভাইরাস সঙ্কটে আমদানি ও রপ্তানি তলানিতে নেমে আসলেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এখনও অর্থনীতিতে আশার আলো জাগিয়ে রেখেছে।

বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১০ জুন পর্যন্ত এক হাজার ৭০৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার (১৭.০৪ বিলিয়ন) রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পুরো সময়ের (জুলাই-জুন) চেয়েও ৪ শতাংশ বেশি।

আর এই রেমিটেন্সের উপর ভর করে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়নও সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠেছে। বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৪ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বেশি রিজার্ভ আর কখনও ছিল না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী ছাইদুর রহমান বৃহস্পতিবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনের প্রথম ১০ দিন (১ জুন থেকে ১০ জুন) ৭২ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

সবমিলিয়ে এই অর্থবছরের ১১ মাস ১০ দিনে (২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ১০ জুন) ১৭ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

এর আগে কখনই কোনো অর্থবছরের পুরো সময়েও এই পরিমাণ রেমিটেন্স আসেনি, জানান ছাইদুর রহমান।

সর্বশেষ মে মাসে রেমিটেন্স এসেছিল ১৫০ কোটি ৪৬ লাখ (১.৫) বিলিয়ন ডলার। তাতে ১১ মাসে রেমিটেন্সের পরিমাণ গত পুরো অর্থবছরের প্রায় সমান হয়ে গিয়েছিল।

এখন তা গত অর্থবছরকে ছাড়িয়ে গেল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল।

২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়ায় কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশের রেমিটেন্স ‘ধাক্কা’ লাগেনি বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

আর সে কারণেই বৃহস্পতিবার ২০২০-২১ অর্থবছরের যে নতুন বাজেট উপস্থাপন করেছেন তাতেও ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে প্রবাস আয় প্রেরণে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, রেমিটেন্স প্রেরণে বর্ধিত ব্যয় লাঘব করা এবং বৈধ পথে অর্থ প্রেরণ উৎসাহিত করা।

“এই পদক্ষেপের কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরের এক মাস বাকি থাকতেই রেকর্ড ১৬ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার প্রবাস আয় অর্জিত হয়েছে; যা দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে বিশেষ অবদান রাখছে।”

মদিনা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে বিলমাসিহ নামক স্থানে মরুভূমির মাঝে একটি কৃষিখামারে কাজ করছেন বাংলাদেশিরা।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা কোটি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ বা রেমিটেন্স। দেশের জিডিপিতে এই রেমিটেন্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো।

মহামারীর অনিশ্চয়তা না কাটায় রেমিটেন্সের গতি যেন ধরে রাখা যায়, সেজন্যই প্রণোদনা অব্যাহত রাখতে চাইছে সরকার।

অর্থমন্ত্রী বলেন, “প্রধান প্রধান শ্রমবাজারে করোনাভাইরাসের ব্যাপক প্রাদুর্ভাবজনিত কারণে এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসের কারণে আগামী অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হতে পারে।

“এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরেও রেমিটেন্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হবে।”

অর্থমন্ত্রী জানান, বর্তমানে বিশ্বের ১৭৪টি দেশে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি অভিবাসী কর্মী কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে গত ১০ বছরেই কর্মসংস্থান হয়েছে ৬৬ লক্ষ ৩৩ হাজারের।

এবার করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ইতোমধ্যেই সাত লাখের মতো প্রবাসী শ্রমিককে দেশে ফিরতে হয়েছে। যারা রয়েছেন, তাদেরও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে তেমন রেমিটেন্স আশা করা হচ্ছিল না।

মার্চ থেকে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ওলটপালট হয়ে যাওয়া ওই নিরাশার দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

এই প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি

গত মার্চে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের রেমিটেন্স এসেছিল, যা গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম।

পরের মাস এপ্রিলে রেমিটেন্স আরও কমে ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলারে আসে, তাও গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ কম।

কিন্তু মে মাসে চিত্র পাল্টাতে থাকে। প্রথম ১১ দিনে ৫১ কোটি ২০ লাখ ডলার রেমিটেন্স আসে,

৩১ মে মাস শেষে সেই রেমিটেন্স গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০ কোটি ৪০ লাখ ডলারে।

কাজী ছাইদুর রহমান বলেন, “মহামারীর কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সঙ্কট চলছে। আমরা ভেবেছিলাম রেমিটেন্সের পরিমাণ একেবারে তলানিতে নেমে আসবে। তবে তা হয়নি। প্রতিবারের মতো এবারও ঈদে পরিবার-পরিজনের জন্য বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়ছেন প্রবাসীরা।”

মহামারীর প্রভাব শুরুর আগে রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের উপরে ছিল।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এবার রেমিটেন্স ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়েই অর্থবছর শেষ হত বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর।

তবে মহামারী চলতে থাকায় রেমিটেন্সের এই গতি নাও থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

আহসান মনসুর বলেন, বাংলাদেশের রেমিটেন্সের বড় অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। জ্বালানি তেলের দাম একেবারে কমে আসায় তেলনির্ভর অর্থনীতির ওই দেশগুলোতেও দেখা দিয়েছে বড় সঙ্কট। ফলে সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতে রেমিটেন্সের জন্য খুব ভালো খবর আসবে বলে তার মনে হয় না।