এবারও লেনদেন ভারসাম্যে বড় ঘাটতি নিয়ে শেষ হচ্ছে অর্থ বছর

বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) ঘাটতি বাড়ছে বাংলাদেশের।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2020, 04:50 PM
Updated : 10 June 2020, 04:50 PM

বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১২ কোটি ৫০ লাখ (৪.১২ বিলিয়ন) ডলার।

অথচ অগাস্ট মাস শেষেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। সেপ্টেম্বর থেকে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ।

মার্চ মাস শেষে অর্থাৎ মাস জুলাই-মার্চ সময়ে এই ঘাটতি ছিল ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।

মহামারীর প্রভাব পড়ার পর এক মাসের ব্যবধানেই লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৪ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। আর পুরো অর্থবছরের (জুলাই-জুন) ঘাটতি ছিল ৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।

মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স কমায় লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বাড়ছে, বলছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

অর্থবছর শেষে এই ঘাটতি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তিনি।

২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হতে আর ২০ দিন বাকি। অর্থাৎ চলতি জুন মাসেই শেষ হবে এই অর্থবছর। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে ২০২০-২১ নতুন অর্থবছর।

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার এপ্রিল পর্যন্ত অর্থাৎ জুলাই-এপ্রিল সময়ের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের তথ্য প্রকাশ করেছে।

তাতে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (দুলাই-অগাস্ট) লেনদেন ভারসাম্যে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

সেপ্টেম্বর থেকে ঘাটতি দেখা দেয়। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই ঘাটতি ছিল ৬৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এর পর প্রতি মাসেই ঘাটতি বেড়ে এপ্রিল শেষে ৪ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে অর্থনীতির সব হিসাবনিকাশই ওলটপালট হয়ে গেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশই এখন গভীর অর্থনৈতিক সংকটে।

এই মহাসঙ্কটকে কীভাবে সামাল দেবে-সেটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “রপ্তানি আয়-রেমিটেন্স কমবেই। কিছুই করার নেই। প্রশ্ন হচ্ছে কত দিন এই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে।

“আর এই ধারা অব্যাহত থাকলে আমদানি ব্যয় কমার পরও চলতি হিসাবের ভারসাম্যে স্বস্তি আসবে না।”

গত দুই অর্থবছরে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় ঘাটতি নিয়ে বছর শেষ হয়েছিল। কিন্তু এবার অর্থবছর শুরু হয়েছিল স্বস্তির মধ্য দিয়ে ২৪ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে। অগাস্ট পর্যন্ত সেই উদ্বৃত্ত ধরে রাখা গিয়েছিল।

আহসান মনসুর বলেন, “কিন্তু রপ্তানিতে বড় ধাক্কার কারণে সেটা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। গত দুই বারের মতো এবারও মনে হচ্ছে বড় ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কেননা সহসা রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।”

সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত

তবে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত রয়েছে বাংলাদেশের। ৬২ কোটি ৩০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে অর্থবছরের ১০ মাস শেষ হয়েছে।

গত অর্থবছরের একই সময়ে ৫৯ কোটি ডলারের ঘাটতি ছিল।

আর্থিক হিসাবেও উদ্বৃত্ত

আর্থিক হিসাবেও (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-এপ্রিল সময়ে এই উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৪৭৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই উদ্বৃত্ত ছিল আরও বেশি, ৫১৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

কোভিড ১৯ মহামারীর মধ্যেও মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ না কমায় সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্য এবং আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত রয়েছে বলে জানান ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।

চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ৫২৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বড় ঘাটতি (ঋণাত্মক) নিয়ে শেষ হয়েছিল গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ৯৫৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হল, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ নেই

পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) নেই বললেই চলে। গত অর্থবছরেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল হতাশাজনক। এবার তার চেয়ে খারাপ।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে পুঁজিবাজারে মাত্র ৭০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল এর ২১ গুণ বেশি; ১৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

জুলাই-এপ্রিল সময়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ বাংলাদেশে এসেছে ৪৫৫ কোটি ডলার। আগের বছরের এই ১০ মাসে এসেছিল ৪৬৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

রেমিটেন্স বেড়েছে ১১.৭১ শতাংশ

করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে এক হাজার ৩৩০ কোটি ৩০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে পাঠিয়েছেন এক হাজার ৪৮৬ কোটি ডলার।

শতাংশ হিসেবে এই ১০ মাসে রেমিটেন্স বেড়েছে ১১ দশমিক ৭১ শতাংশ।

তবে করোনাভাইরাসের ধাক্কায় রেমিটেন্সের এই প্রবৃদ্ধি আর নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেন ভারসাম্যের ১০ মাসের তথ্য প্রকাশ করলেও রেমিটেন্সের ১১ মাসের (জুলাই-মে) তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

তাতে দেখা যায়, এই ১১ মাসে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৮ দশমিক ৭২ শতাংশে।

এফডিআই কমেছে ১৪.৩৬ শতাংশ

গত অর্থবছরের মতো প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ইতিবাচক ধারা আর নেই।

গত অর্থছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৪২৯ কোটি ৭০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। এই অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৩৬৮ কোটি ডলার।

এ হিসাবে ১০ মাসে এফডিআই কমেছে ১৪দশমিক ৩৬ শতাংশ।

জুলাই-এপিল সময়ে বাংলাদেশে নিট এফডিআই এসেছে ১৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আগের বছরে একই সময়ে এসেছিল ২৩৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

এ হিসাবে এই দশ মাসে নিট এফডিআই কমেছে ২০ শতাংশ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে।

বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে

বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপিল) পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪২২ কোটি ১০ লাখ (১৪.২২ বিলিয়ন) ডলার। গত বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল এক হাজার ৩৯৭ কোটি ৮০ লাখ (১৩.৯৯বিলিয়ন) ডলার।

আমদানি কমায় অর্থবছরের তিন মাস পর্যন্ত পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি আগের অর্থবছরের চেয়ে কম ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ঘাটতি ছিল ৩৮৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ছিল তার থেকে কম ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

তবে রপ্তানি আয়ে ধসের কারণে এরপর থেকেই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে থাকে, এমনকি আমদানি ব্যয় কমার পরও বাড়ছে এই ঘাটতি।

গত মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রপ্তানির পাশাপাশি আমদানিও পাল্লা দিয়ে কমছে। সে কারণেই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-এপিল সময়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) মোট চার হাজার ২৯৭ কোটি  ৪০ লাখ (৪২.৯৭ বিলিয়ন) ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। আর পণ্য রপ্তানি থেকে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) আয় করেছে দুই হাজার ৮৭৫ কোটি ৩০ লাখ (২২.৩৬ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবেই বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার।

তথ্যে দেখা যায়, এই দশ মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আর রপ্তানি আয় কমেছে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পুরো সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫৪৯ কোটি ৪০ লাখ (১৫.৪৯ বিলিয়ন) ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ১৮ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিগত বছরগুলোতে আমদানি খাতে ব্যয় বাড়ার কারণে রপ্তানি আয় বাড়লেও বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু এবার আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয় কমায় বাড়ছে এই ঘাটতি।

সেবা বাণিজ্যেও ঘাটতি বেড়েছে

সেবা খাতেও বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। জুলাই-এপ্রিল সময়ে এ খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩১১ কোটি ১০ লাখ (৩.১১ বিলিয়ন) ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ২৬৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

মূলত বীমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।