এবারও বড় বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে শেষ হচ্ছে বছর

পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি বাড়ছে। আমদানি ব্যয় কমার পরেও বাণিজ্য ঘাটতি কমছে না।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2020, 07:47 PM
Updated : 2 June 2020, 07:47 PM

রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধাক্কার কারণে এই ঘাটতি বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

মাহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আহসান মনসুর বলছেন, বড় বাণিজ্য ঘাটতির পাশাপাশি লেনদেন ভারসাম্যেও ঘাটতি নিয়ে চলতি অর্থবছর শেষ করতে হবে বাংলাদেশকে।

২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হতে এক মাসেরও কম সময় বাকি। অর্থাৎ চলতি জুন মাসেই শেষ হবে এই অর্থবছর। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে ২০২০-২১ নতুন অর্থবছর।

বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২০৭ কোটি ৮০ লাখ (১২.০৮ বিলিয়ন) ডলার। গত বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল কাছাকাছি, এক হাজার ২২০ কোটি (১২.২২ বিলিয়ন) ডলার।

আমদানি কমায় অর্থবছরের তিন মাস পর্যন্ত পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি আগের অর্থবছরের চেয়ে কম ছিল।২০১৮-১৯ অর্থছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ঘাটতি ছিল ৩৮৫ কোটি ২০ লাখ ডলার।২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ছিল তার থেকে কম ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

তবে রপ্তানি আয়ে ধসের কারণে এরপর থেকেই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে থাকে, এমনকি আমদানি ব্যয় কমার পরও বাড়ছে এই ঘাটতি।

গত মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রপ্তানির পাশাপাশি আমদানিও পাল্লা দিয়ে কমছে।

সে কারণে গত দুই অর্থবছরের মত বড় ঘাটতি নিয়েই চলতি অর্থবছর শেষ হবে বলে মনে করছেন আহসান মনসুর।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) মোট চার হাজার ৩৩ কোটি (৪০.৩৩ বিলিয়ন) ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। আর পণ্য রপ্তানি থেকে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) আয় করেছে দুই হাজার ৮২৫ কোটি ২০ লাখ (২২.৩৬ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবেই বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার।

তথ্যে দেখা যায়, এই নয় মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর রপ্তানি আয় কমেছে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পুরো সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫৪৯ কোটি ৪০ লাখ (১৫.৪৯ বিলিয়ন) ডলার।২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ১৮ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিগত বছরগুলোতে আমদানি খাতে ব্যয় বাড়ার কারণে রপ্তানি আয় বাড়লেও বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু এবার আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয় কমায় বাড়ছে এই ঘাটতি।

সেবা খাতেও ঘাটতি বেড়েছে

সেবা খাতেও বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। জুলাই-মার্চ সময়ে এ খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩২৮ কোটি ৩০ লাখ (৩.২৮ বিলিয়ন) ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ২৪০ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

মূলত বীমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ২.৬৫ বিলিয়ন ডলার

জুলাই-মার্চ সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬৪ কোটি ৮০ লাখ (২.৬৫ বিলিয়ন) ডলার।

গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪২১ কোটি ২০ লাখ ডলার।

অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই ঘাটতি ছিল ৬৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

অথচ অগাস্ট মাস শেষেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে অর্থনীতির সব হিসাবনিকাশই ওলোটপালট হয়ে গেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশই এখন গভীর অর্থনৈতিক সংকটে।”

এই মহাসংকট কে কীভাবে সামাল দেবে-সেটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “রপ্তানি আয়-রেমিটেন্স কমবেই। কিছুই করার নেই। প্রশ্ন হচ্ছে কত দিন এই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে।

“আর এই ধারা অব্যাহত থাকলে আমদানি ব্যয় কমার পরও চলতি হিসাবের ভারসাম্যে স্বস্তি আসবে না। বাণিজ্য ঘাটতি কমবে না।”

তিনি বলেন, গত দুই অর্থবছরে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় ঘাটতি নিয়ে বছর শেষ হয়েছিল। কিন্তু এবার অর্থবছর শুরু হয়েছিল স্বস্তির মধ্য দিয়ে ২৪ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে। অগাস্ট পর্যন্ত সেই উদ্বৃত্ত ধরে রাখা গিয়েছিল।

“কিন্তু রপ্তানিতে বড় ধাক্কার কারণে সেটা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। গত দুই বারের মত এবারও মনে হচ্ছে বড় ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কেননা সহসা রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।”

সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত

তবে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত রয়েছে বাংলাদেশের। ৩৪ কোটি ৫০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে অর্থবছরের নয় মাস শেষ হয়েছে।

গত অর্থবছরের একই সময়ে ৩২ কোটি ৬০ লাখ ডলারের ঘাটতি ছিল।

আর্থিক হিসাবেও (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-মার্চ সময়ে এই উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৩৪৯ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই উদ্বৃত্ত ছিল আরও বেশি, ৪৩৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ৫২৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বড় ঘাটতি (ঋণাত্মক) নিয়ে শেষ হয়েছিল গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ৯৫৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হল, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

রেমিটেন্স বেড়েছে ১৬ শতাংশ

করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে এক হাজার ১৮৭ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে পাঠিয়েছেন এক হাজার ২৫০ কোটি ডলার।

শতাংশ হিসেবে এই নয় মাসে রেমিটেন্স বেড়েছে ১৬ দশমিক ০৬ শতাংশ।

তবে করোনাভাইরাসের ধাক্কায় রেমিটেন্সের এই প্রবৃদ্ধি আর নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেন ভারসাম্যের নয় মাসের তথ্য প্রকাশ করলেও রেমিটেন্সের ১১ মাসের (জুলাই-মে) তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

তাতে দেখা যায়, এই ১১ মাসে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৮ দশমিক ৭২ শতাংশে।

এফডিআই কমেছে ১১ শতাংশ

গত অর্থবছরের মতো প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ইতিবাচক ধারা আর নেই।

গত অর্থছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৩৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। এই অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৩৪৫ কোটি ডলার।

এ হিসাবে নয় মাসে এফডিআই কমেছে ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ।

জুলাই-মার্চ সময়ে বাংলাদেশে নিট এফডিআই এসেছে ১৮০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আগের বছরে একই সময়ে এসেছিল ২২০ কোটি ২০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে।

পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ নেই

পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) নেই বললেই চলে। গত অর্থবছরেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল হতাশাজনক।এবার তার চেয়ে খারাপ।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে পুঁজিবাজারে মাত্র ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল এর ১০ গুণের বেশি; ১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

জুলাই-মার্চ সময়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ বাংলাদেশে এসেছে ৪১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আগের বছরের এই নয় মাসে এসেছিল ৪৩১ কোটি ৪০ লাখ ডলার।