‘অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফেরানোই বাজেটের লক্ষ্য হওয়া উচিত’

নতুন করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে মহামারীর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াটাই ২০২০-২১ সালের বাজেটের বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা।

ফারহান ফেরদৌসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 May 2020, 01:16 PM
Updated : 31 May 2020, 04:19 AM

তারা স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, আরও বেশি মানুষকে করের আওতায় আনা, আয় বৈষম্য যাতে আরও না বড়ে সেদিকেও নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। 

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে আগামী ১০ জুন বসছে সংসদের অষ্টম অধিবেশন। এই অধিবেশনেই ১১ জুন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব তুলবেন অর্থমন্ত্রী।

কর বাবদ সোয়া তিন লাখ কোটি টাকা আদায়ের বিশাল স্বপ্ন নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শুরু হলেও মহামারীর ধাক্কায় অর্থবছর শেষে সেই লক্ষ্য পূরণে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা।

বিশাল এই ঘাটতি নিয়ে নতুন বাজেট তৈরি করতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আর অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের।

প্রবৃদ্ধির লক্ষতেও বড় ধরনের ধাক্কার আভাস পাওয়া গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। কিন্তু বিশ্ব ব্যাংকের আভাস প্রবৃদ্ধির হার কমে ২-৩% হতে পারে।

তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মতে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে প্রবৃদ্ধি কমলেও সেটি ৬ শতাংশের ওপরেই থাকবে।

বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে কেমন হওয়া উচিত নতুন বাজেট? বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এ প্রশ্ন ছিল দেশের তিন অর্থনীতিবিদের কাছে।  

জবাবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, “এখন উন্নয়নের চাইতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার রিকভারিতে। সেটার জন্য সরকারকে ফিসকাল ছাড় দিতে হবে।

“অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে যেসব নীতি সহায়তা দরকার সেগুলো সরকারকে করতে হবে। উন্নয়ন বাজেটে সেসব খাতকেই গুরুত্ব দিতে হবে, যেগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সাথে জড়িত।”

তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য খাতে যেসব প্রকল্প আছে সেগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যান্য জিনিস যেমন ভৌত অবকাঠামো, রাস্তা-ঘাট এগুলো দু’দিন পরে হলেও চলবে। আপাতত বছরখানেক আমাদের অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় নিতে যে জিনিসগুলো করা দরকার সেগুলো করতে হবে।”

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।

২০১৫-১৬ অর্থবছরের পার আর ৭ শতাংশের নিচে নামেনি জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার।

এর আগে ২০১৭-১৮, ২০১৬-১৭ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৮৬, ৭ দশমিক ২৮ ও ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।

৬ শতাংশের নিচে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২০০৯-১০ অর্থবছরে। সেবার ছিল ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

২০০৯-১০ অর্থবছরের পর আর ৬ শতাংশের নিচে নামেনি প্রবৃদ্ধির হার।

২০১০-১১, ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৪৬, ৬ দশমিক ৫২, ৬ দশমিক ০১, ৬ দশমিক ০৬ এবং ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ ।

যেসব খাতে বেশি নজর দিতে হবে

অর্থনীতিবিদ কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ বলেন, “সবার আগে নজর দিতে হবে স্বাস্থ্য খাতে। ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য যা যা লাগে- ডাক্তার হোক, নার্স হোক অথবা হাসপাতাল, সেখানে বিনিয়োগ করতে হবে।

“সামাজিক এবং খাদ্য নিরাপত্তায় নজর দিতে হবে। করোনাকালে অনেক পরিবার সমস্যায় পড়ে গেছে, তাদের হাতে নগদ টাকা পৌঁছে দিলে ভালো হয়। তাহলে অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরি হবে। আবার পরিবারগুলো না খেয়ে মারা যাবে না। পাশাপাশি শিক্ষায় নজর দিতে হবে।”

২০১৯-২০ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে জনপ্রশাসনে সর্বোচ্চ খরচ ধরা হয়েছিল ১৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে ধরা হয়েছিল ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। কৃষি ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ।  

এই বাজেটের চ্যালেঞ্জ কি?

ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকসের সহযোগী অধ্যাপক এ কে এম নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই বাজেট দেয়া সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। একদিকে স্বাস্থ্য, কৃষি এবং সামাজিক নিরাপত্তায় ও কল্যাণে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

“অন্যদিকে ব্যবসা বন্ধ, রপ্তানি স্থবির। কর থেকে আয় কমে যাবে, ভ্যাট থেকে আয় কমে যাবে। টাকা আসবে না কিন্তু সরকারকে অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়াতে হবে।”

২০১৯-২০ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থায়নের উত্স হিসেবে সবচেয়ে বড় খাত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর। এই উত্স থেকে সরকার প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ টাকা আয় করে। ভ্যাট থেকে আসে ৩৭ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং আয়কর থেকে আসে ৩৫ শতাংশ।

অধ্যাপক নজরুল বলেন, “এই সমস্যা থেকে বের হতে হলে যারা কর দিচ্ছে না তাদেরকে করের আওতায় আনতে হবে।”

আয় বৈষম্যর দিকেও নজর দিতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

“গত ১০-১২ বছরে আমাদের দেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে অনেক। কিন্তু সবার আয় এক রকম হারে বাড়েনি। কারও আয় অনেক বেড়ে গেছে। আবার কারও কারও অতটা বাড়েনি অথবা কমেছে। এই অবস্থায় বাজেট প্রণয়নের সময় আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যেন আয় বৈষম্য আরও না বাড়ে।

“যেহেতু ভ্যাট সবাইকে সমানভাবে দিতে হয়, ধনী এবং গরীব একই হারে ভ্যাট দেয়, তাই ভ্যাটের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। একটা সুচিন্তিত সম্পদ কর ব্যবস্থা যদি তৈরি করতে পারি তাহলে সেটা বৈষম্য কমাতে কাজে লাগতে পারে।”

একটি দেশের আয় বৈষম্য মাপা হয় জিনি সহগ (Gini coefficient) দিয়ে।

জিনি সহগ অর্থনীতির একটি সূচক, যা কোনো দেশের আয় বা সম্পদ বণ্টনের অসমতা বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। এর মান ০ থেকে ১-এর মধ্যে হবে।
 

সংজ্ঞানুসারে জিনি সহগের মান কম হলে তা অপেক্ষাকৃত সমান আয় বা সম্পদের বিতরণ নির্দেশ করে। অন্যদিকে মান উচ্চ হলে তা আয় বা সম্পদ বিতরণে অধিকতর অসমতা নির্দেশ করে।

‘০’ নির্দেশ করে চরম সমতা (অর্থাৎ সবার আয় বা সম্পদ সমান)। ১ নির্দেশ করে চরম অসমতা (অর্থাৎ একজন ব্যক্তি সব অর্থ আয় করেন, বাকীরা কোনো আয় করেন না)।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর সর্বশেষ তথ্য থেকে দেখা যায় বাংলাদেশে আয় বৈষম্য বাড়ছে। ২০১০ সালে দেশের জিনি সহগ ছিল দশমিক ৪৫৮ কিন্তু ২০১৬ সালে সেটা বেড়ে হেয়েছে দশমিক ৪৮৩।