রেমিটেন্সে উল্লম্ফন, রিজার্ভ ফের ৩৩ বিলিয়ন ছাড়াল

করোনাভাইরাস সঙ্কটে আমদানি ও রপ্তানি তলানিতে নেমে আসলেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আশার আলো জাগিয়ে যাচ্ছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2020, 01:35 PM
Updated : 20 May 2020, 01:46 PM

ঈদ সামনে রেখে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

চলতি মে মাসের প্রথম ১৯ দিনে ১০৯ কোটি ১০ লাখ ডলার তারা দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত এপ্রিল মাসের পুরো সময়ের চেয়েও বেশি। এপ্রিলে ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

রেমিটেন্সের এই উল্লম্ফনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ফের ৩৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।

করোনাভাইরাস মহামারী গোটা বিশ্বকে সঙ্কটে ফেলে দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের রেমিটেন্সেও পড়েছে তার প্রভাব। আশঙ্কা করা হয়েছিল, আমাদানি ও রপ্তানি আয়ের মত অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক রেমিটেন্সও তলনিতে নেমে আসবে। কিন্তু তেমনটি হয়নি।

গত মার্চ থেকে রেমিটেন্স কমে যাওয়া দেখে খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না অর্থনীতিবিদরা।

কিন্তু ঈদের মাস মে’তে অতীতের যে কোনো ঈদের মাসের চেয়ে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী ছাইদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মহামারীর কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সঙ্কট চলছে। আমরা ভেবেছিলাম রেমিটেন্সের পরিমাণ একেবারে তলানিতে নেমে আসবে।

“তবে তা হয়নি। প্রতিবারের মত এবারও ঈদে পরিবার-পরিজনের জন্য বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।”

অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সত্যি কথা বলতে কি, আমরা ভেবেছিলাম আমদানি ও রপ্তানি আয়ের মতো রেমিটেন্সও একেবারে তলনিতে নেমে আসবে। কিন্তু তা হয়নি।”

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা কোটি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ। জিডিপিতে এই রেমিটেন্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো।

প্রতি বছরই ঈদের আগে রেমিটেন্সে গতি আসে। গত বছরের রোজার ঈদের আগে মে মাসে ১৭৪ কোটি ৮২ লাখ ডলারের রেকর্ড রেমিটেন্স এসেছিল। প্রথম ১৯ দিনে এসেছিল ১০৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

এবার করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অনেক প্রবাসী শ্রমিককে দেশে ফিরতে হওয়ায় এবং যারা রয়েছেন, তাদেরও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে তেমন রেমিটেন্স আশা করা হচ্ছিল না।

মার্চ থেকে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ওলটপালট হয়ে যাওয়া ওই নিরাশার দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

গত মার্চে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের রেমিটেন্স এসেছিল, যা গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম।

পরের মাস এপ্রিলে রেমিটেন্স আরও কমে ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলারে আসে, তাও গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ কম।

কিন্তু মে মাসে চিত্র পাল্টাতে থাকে। প্রথম ১১ দিনে ৫১ কোটি ২০ লাখ ডলার রেমিটেন্স আসে, ১৩ মে পর্যন্ত আসে ৬৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ১৪ মে পর্যন্ত আসে ৮০ কোটি ডলার। ১৯ মে তা ১০৯ কোটি ১০ লাখ  ডলারে গেল।

গত বছরের ঈদের মাস মে মাসের প্রথম ১৯ দিনে যে পরিমাণ রেমিটেন্স এসেছিল, এই বছরের সেই সময়ে তার সমান রেমিটেন্স এসেছে।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১৯ মে সময়ে এক হাজার ৪৩৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। চলতি অর্থবছরের ১৯ মে পর্যন্ত এসেছে ১ হাজার ৫৯৫ কোটি ২০ লাখ ডলার।

এ হিসাবে ১৯ মে পর্যন্ত রেমিটেন্স প্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ।

ঈদের পাশাপাশি রেমিটেন্সে ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনার শর্ত শিথিল করার প্রভাবও এতে পড়ছে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা ছাইদুর।

তবে আহসান মনসুর বলেন, “একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, এখন উপার্জন বা কাজের টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন না তারা (প্রবাসী)। জমানো টাকা যেটা ছিল সেখান থেকেই অথবা অন্য কারও কাছ থেকে ধার করে পরিবারের-পরিজনের বিপদের দিনে কিছু পাঠাচ্ছেন। সেটা ফুরিয়ে গেলে আর পাঠাতে পারবেন না।”

মহামারীর প্রভাব শুরুর আগে রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের উপরেই ছিল।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এবারও রেমিটেন্স ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়েই অর্থবছর শেষ হত বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের রেমিটেন্সের বড় অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। জ্বালানি তেলের দাম একেবারে কমে আসায় তেলনির্ভর অর্থনীতির ওই দেশগুলোতেও দেখা দিয়েছে বড় সঙ্কট। ফলে সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতে রেমিটেন্সের জন্য খুব ভালো খবর আসবে বলে তার মনে হয় না।

তবে এরপরও রেমিটেন্সে ১০/১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হবে বলে মনে করেন তিনি।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল আরও বেশি; ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ।

রিজার্ভ ৩৩.২ বিলিয়ন ডলার

ঈদের আগে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় রপ্তানি আয় কমার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার ফের ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

বুধবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৩২০ কোটি (৩৩.২০ বিলিয়ন) ডলার।

তবে এশীয় উন্নয় ব্যাংকের (এডিবি) ২৫ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা যোগ হওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে বলে জানান ছাইদুর রহমান।

চলতি মে মাসের প্রথম সপ্তাহে রিজার্ভ ৩৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মাসের আমদানি বিল পরিশোধের পর তা কমে আসে।

৮২ কোটি ২০ লাখ ডলার বিক্রি

এদিকে বাজারে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বুধবারও ১ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে।

সবমিলিয়ে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১৯ মে পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে আন্ত:ব্যাংক মুদ্রার বাজার দরে ৮২ কোটি ২০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বুধবার আন্ত:ব্যাংক মুদ্রার বাজারে প্রতি ডলারের দর ছিল ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সা।

আরও খবর