দেশের অধিকাংশ প্রকল্পে চীনের বিশেষজ্ঞ এবং কর্মীই বেশি। আর গতবছরের শেষ দিকে চীন থেকেই ছড়াতে শুরু করে নভেল করোনাভাইরাস। ফলে প্রথমদিকের ওই সময়ে চীনের যেসব কর্মী ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আর ফিরতে পারেননি।
মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের পর ধীরে ধীরে অবরুদ্ধ পরিস্থিতে চলে যায় পুরো দেশ। এ অবস্থায় সব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। লকডাউন এঠ গিয়ে কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তারও কোনো ঠিক নেই। ফলে নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ করা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
দেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের তদারকির দায়িত্বে থাকা বাস্তবায়ন, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএইডি) সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লকডাউনের কারণে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশের উন্নয়ন কাজও স্থবির হয়ে পড়েছে।
“আমরা প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অফিসিয়াল কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে কী অবস্থা সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তবে বোঝা যাচ্ছে লকডাউনের কারণে প্রকল্পের কর্মকাণ্ড চলছে না।”
পদ্মা সেতু
সেতু বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পেও করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর জানুয়ারি মাসেও এ প্রকল্পে প্রায় সাড়ে চার হাজার শ্রমিক কাজ করছিলেন।
চীনাসহ বিদেশি শ্রমিকরা চলে যাওয়ার পরও মার্চের শুরুতে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক ছিলেন। কিন্তু লকডাউন শুরুর পর প্রায় সব শ্রমিকই চলে গেছে বলে জানান তিনি।
প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে এ পর্যন্ত ২৮টি বসানো হয়েছে।
“বর্তমানে প্রকল্পে সীমিত আকারে কাজ চললেও একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে কাজের গতি অনেক কমে গেছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী প্রকল্পটির ভৌত কাজ প্রায় ৭৯ শতাংশ শেষ হয়েছে।”
তবে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
“করোনাভাইরাসের প্রভাব শেষ হলে আমরা হিসাব করে বলতে পারব সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে শেষ করতে পারব কিনা।”
সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এ প্রকল্পের অগ্রগতির হার মাত্র দুই শতাংশের মতো।
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প
পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ৩৯ হাজার ২৫৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭৩ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ বসানো হচ্ছে।
২০১৬ সালে প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের সময় এর ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর। কিন্তু ২০১৮ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের ব্যয় আরও চার হাজার ২৬৯ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটির সড়কপথের সঙ্গেই এটিও উদ্বোধনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করায়
২০২১ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্যে কাজ চলছে।
প্রকল্পটির অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, “করোনা প্রাদুর্ভাব প্রকল্পের কাজেও পড়েছে। সারা দেশ লকডাউন থাকায় দেশীয় বেশিরভাগ জনবল যার যার অবস্থানে চলে গেছে।
“তবে আমরা খুবই দরকার এরকম কিছু জনবল রেখে দিয়েছি। তাদেরকে আমাদের ব্যবস্থাপনায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তারা কাজ করছেন। আর বিদেশি জনবলও রয়েছে। তারাও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।”
গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকল্পে ২৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, “করোনার প্রভাব কতদিন স্থায়ী হবে তার ওপর নির্ভর করছে মেয়াদের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন।”
বেশিদিন স্থায়ী হলে নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হবে না বলে জানান তিনি।
মেট্রোরেল
প্রকল্পটি দুটি অংশ করে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রথমটি উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত। এই অংশের পূর্ত কাজের অগ্রগতি প্রায় ৭০ শতাংশ। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দ্বিতীয় অংশের পূর্ত কাজের অগ্রগতি ৩৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
ইলেক্ট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রোলিং স্টক (রেলকোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ কাজের সমন্বিত অগ্রগতি ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। ইতোমধ্যে ৯ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট দৃশ্যমান হয়েছে। স্প্যানও বসানো হয়েছিল প্রায় ৫ কিলোমিটার। শুরু হয়েছিল রেললাইন বসানোর কাজও ।
প্রকল্পটির বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক মো. আফতাব উদ্দিন তালুকদার ও অতিরিক্ত পরিচালক মো. হারুন অর রশিদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা সাড়া দেননি।
ফেব্রুয়ারিতে মেট্রোরেলের রেপ্লিকা কোচ ঢাকায় এসে পৌঁছালে বর্তমানে প্রকল্পটির কাজ পুরোপুরি বন্ধ দেখা গেছে।
এই প্রকল্পটির জন্য চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) প্রায় ৭ হাজার ২১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মাত্র ১ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে প্রকল্পটি চালু করার লক্ষ্য থাকলেও তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন
১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পটির জন্য শেষ পর্যন্ত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে ১৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করে আর্থিক সংস্থান করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে পুরোদমে কাজ শুরু হওয়ার পর গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ৪০ শতাংশ অগ্রগতি অর্জিত হয়।
২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য থাকলেও দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত শেষ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে। প্রকল্পটি স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে উদ্বোধন করার আগ্রহ প্রধানমন্ত্রীর।
কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এই প্রকল্পের কাজও প্রায় বন্ধ।
প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান বলেন, “প্রকল্পটির কাজ প্রায় বন্ধই বলা চলে। জানুয়ারি মাসে চীনে করোনাভাইরাস ছড়ানো শুরু হওয়ার পর সেখানকার বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশে আসার ওপর বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছিল। এখন বাংলাদেশে লকডাউনের কারণে তারা আসতে পারছে না।”
কর্ণফুলী টানেল
সর্বশেষ গত ১০ মার্চ পর্যন্ত এ প্রকল্পের মোট ৫১ শতাংশ বাস্তবায়িত হলেও এখন কাজের গতি কমে এসেছে।
তবে প্রকল্পটিতে এখনও চীনা নাগরিকরা কাজে থাকলেও দেশীয় জনবল নেই বলে সেতু কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
কর্ণফূলী নদীর তলদেশের নিচে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার টানেল, দুই মুখে সড়ক আর ওভারপাস বা সেতুসড়ক নির্মিত হচ্ছে।
২০১৫ সালে অনুমোদন পাওয়া এই প্রকল্পটি চীনা সরকার সময়মতো অর্থ ছাড় না করায় কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের শেষের দিকে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানে প্রথম ইউনিটের রিয়েক্টর বিল্ডিংয়ের ইনার কন্টেনমেন্ট ওয়ালের ২০ মিটার থেকে ৩৪ দশমিক পাঁচ মিটার দেয়াল নির্মাণের কার্যক্রম চলছে। আশা করছি বছরের শেষ দিক আমরা প্রথম ইউনিটের প্রথম রিয়েক্টর বসাতে পারব।”
এ পর্যন্ত প্রকল্পটির প্রায় ২৬ শতাংশের কাছাকাছি বাস্তবায়িত হয়েছে বলেও জানান পরিচালক।
রাশিয়ার সহযোগিতায় বাংলাদেশের প্রথম এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুটি ইউনিটে ১২০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।
প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৪ সালের অক্টোবরে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে।