মহামন্দার পর সবচেয়ে খারাপ সময় ‘আসছে’

বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের ছোবলে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। নতুন এই ভাইরাস একদিকে যেমন কেড়ে নিচ্ছে বহু প্রাণ, অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে খাদের কিনারে, যার জের টানতে হতে পারে লম্বা সময় ধরে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2020, 10:41 AM
Updated : 16 April 2020, 10:51 AM

অর্থনীতিকে কতটা ধসিয়ে দিয়ে যেতে পারে করোনাভাইরাস, তার একটা আভাস কয়েকদিন আগেই দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমফ)।

সংস্থাটি বলছে, গত কয়েক দশকের মধ্যে বিভিন্ন দেশ করোনাভাইরাসের কারণে যেভাবে ডুবতে বসেছে, তাতে এবছর বিশ্ব অর্থনীতি মাত্র ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখতে পারবে। সেখানে এশিয়ার অবদান শূন্য। অর্থাৎ এ বছর এশিয়ার অর্থনীতিতে কোনো প্রবৃদ্ধিই হবে না।  

আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপিনাথ বলেছেন, এই সঙ্কটের কারণে আগামী দুই বছরে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নয় লাখ কোটি ডলার কমে যেতে পারে।  

আইএমএফের দৃষ্টিতে, ১৯৩০ এর দশকের মহামন্দার পর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি।

ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দীর্ঘস্থায়ী হলে অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে বড় ধরনের পরীক্ষার মুখে পড়তে হতে পারে বলে মনে করে আইএমএফ ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সর্বশেষ বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে (ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক) সঙ্কট মোকাবেলায় যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপের প্রশংসা করা হলেও কোনো দেশই অবনতি ঠেকাতে পারবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।    

চলতি বছরের মাঝামাঝিতে যদি মহামারী কিছুটা কমে আসে, সেক্ষেত্রে আগামী বছর বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছে আইএমএফ।

“নীতিনির্ধারক, যারা এই ধাক্কার স্থায়িত্ব এবং গভীরতা নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় আছেন, তাদের জন্য ‘ভয়ঙ্কর বাস্তবতা’ হল বড় এই লকডাউন,” বলেন গীতা গোপিনাথ।

তিনি বলেন, ২০২১ সাল নাগাদ ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির আংশিক পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য স্থির করা হলেও ভাইরাস-পূর্ব সময়ের চেয়ে নিচেই থাকবে প্রবৃদ্ধি; সঙ্গে অর্থনীতি পুরুদ্ধারের বিষয়টিও অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে।”

সঙ্কটটা বৈশ্বিক

অর্থনীতিবিদ গীতা গোপিনাথ বলছেন, ১৯৩০ এর দশকের পর প্রথমবারের মতো উন্নত এবং উন্নয়শীল- সব ধরনের দেশই বড় অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়তে পারে।   

উন্নত দেশগুলো ২০২২ সালের আগে ভাইরাস-পূর্ববর্তী অর্থনীতিতে ফিরতে পারবে না বলেও সতর্ক করেছে আইএমএফ।

জানুয়ারিতে সংস্থাটি যুক্তরাজ্যের প্রবৃদ্ধি এবছর এক দশমিক চার শতাংশ বাড়ার আভাস দিয়েছিল। কিন্তু এখন উল্টো দেশটির প্রবৃদ্ধি ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশ কমে যাবে বলা হচ্ছে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির হার এবছর ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে, যা হবে ১৯৪৬ সালের পর দেশটির প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় পতন। এছাড়া দেশটিতে বেকারত্বের হার এ বছর বেড়ে ১০ দশমিক চার শতাংশ বেড়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে আগামী বছর ৪ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

এশিয়ার অর্থনীতিও গত ৬০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো শূন্য প্রবৃদ্ধি দেখতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।

নভেল করোনাভাইরাসের উৎসস্থল, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎঅর্থনীতি চীনে ১৯৭৬ সালের পর এ বছর প্রবৃদ্ধি অর্জনে সবচেয়ে শ্লথগতি দেখছে এই সংস্থা। দেশটির প্রবৃদ্ধি এবছর মাত্র এক দশমিক দুই শতাংশ বাড়তে পারে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে।

তবে ওয়াশিংটনভিত্তিক এই ঋণদাতা সংস্থার দৃষ্টিতে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে আরোপ করা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাগুলো যদি সফল হয় তাহলে আগামী বছর এশিয়ার প্রবৃদ্ধি সাত দশমিক ছয় শতাংশ হতে পারে। তবে সেটাও নিশ্চিত নয়।

ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে জারি করা লকডাউনের বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে এই অঞ্চলের বিমান পরিবহন, শিল্পকারখানা, দোকানপাট এবং রেস্তোরাঁগুলোর ওপর। এ অবস্থা থেকে এশিয়ার সেবা খাতের ঘুরে দাঁড়ানোটাই কঠিন হবে বলে মনে করে আইএমএফ।  

পরিস্থিতি মোকাবেলায় এশিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ব্যাতিক্রমী কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংস্থার এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক চ্যাংইয়ং রি।

“এখন আসলে ব্যবসা করার মতো পরিস্থিতি নয়। এখন এশিয়ার দেশগুলোর উচিত হবে তাদের ভাণ্ডারে থাকা সব ধরনের নীতি প্রয়োগ করা।”

চলাচলে নিষেধাজ্ঞা, সামাজিক দূরত্ব এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোকে নীতিনির্ধারকদের এখন অবশ্যই সহয়তা দেওয়া উচিত বলে মনে করে আইএমএফ। 

বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির এমন দশায় ‘মারাত্মক ঝুঁকি’ দেখছে তারা।

সংস্থাটির মতে, যদি মহামারী নিয়ন্ত্রণে বেশি সময় লাগে আর আগামী বছর আবারও এর ধাক্কা আসে, তাহলে প্রবৃদ্ধি আরও ৮ শতাংশ কমে যেতে পারে।  

এর ফলে ঋণভারে জর্জরিত দেশগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা এমন কিছু দেশকে অর্থ দিতে আগ্রহী না হলে তাদের ঋণের ব্যয় বেড়ে যেতে পারে।

“সার্বভৌম ঋণের ব্যয় বাড়লে কিংবা শুধু এমন শঙ্কা থেকেই অনেক দেশ অর্থ সহায়তা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে।”

অর্থনৈতিক দাওয়াই

আইএমএফ বলছে, দীর্ঘ সময় ধরে চলা লকডাউন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সঙ্কুচিত করলেও কোয়েরেন্টিন এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

“ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকানো, স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা দাঁড় করানোর সঙ্গে দ্রুত ও বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরুর পথ তৈরি করতে হলে কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপগুলো জরুরি।

মহামারী সামলাতে স্বাস্থ্য সেবায় আরও বেশি অর্থ ব্যয়, শ্রমিক এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে আর্থিক সহায়তা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অব্যাহত সহযোগিতা এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে স্বচ্ছ পরিকল্পনা গ্রহণ- এই চারটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে আইএমএফ।

নভেল করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক খুঁজে করার পাশাপাশি চিকিৎসাসেবা ছড়িয়ে দিতে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

তাছাড়া সামনের দিনগুলোতে অনেক দেশকেই ঋণ মওকুফ করার সুবিধা দিতে হতে পারে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।