আইএমএফের কাছে ৭০ কোটি ডলার চায় বাংলাদেশ

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিশাল অংকের প্রণোদনা ঘোষণার পর এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে জরুরি সহায়তা হিসেবে ৭০ কোটি ডলার চেয়েছে বাংলাদেশ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 April 2020, 11:44 AM
Updated : 10 April 2020, 02:21 PM

শুক্রবার নিক্কেই এশিয়ান রিভিউয়ের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

ঢাকায় আইএমএফের প্রতিনিধি র‌্যাগনার গুডমান্ডসন পত্রিকাটিকে বলেন, “বাংলাদেশ সরকার যে জরুরি সহায়তা চেয়েছে, সেটি আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি।”

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউন পরিস্থিতির কারণে দেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রোববার (৫ এপ্রিল) ৭২ হাজার কোটি ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন, যা জিডিপির ২.৫২ শতাংশ।

প্রণোদনা ঘোষণার পরপরই আইএমএফের কাছে জরুরি সহায়তা চাওয়ার খবর পাওয়া গেল।

“জরুরি এই সহায়তার মানে হল- অর্থনীতি সচল রাখা, মানুষের, বিশেষ করে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ লাঘব এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা,” বলেন গুডমান্ডসন।

বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, সরকার ঘোষিত প্রণোদনার লক্ষ্য হল- তারল্য বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্য চালু রাখা এবং বেকারত্ব কমিয়ে আনার মাধ্যমে অর্থনীতি পুনর্গঠন।

প্রণোদনার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এবং ব্যাংক থেকে অর্থ পাওয়ার ‍সুযোগ নেই এমন ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান যাতে প্রণোদনার অর্থ পায় সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে এফবিসিসিআই কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

“মূল পরিকল্পনা হল যতটা সম্ভব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা,” নিক্কেইকে বলেন ফাহিম।

প্রধানমন্ত্রী যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন সেখানে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দিতে ২৩৫ কোটি ডলারের তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ঋণ দেবে। এক্ষেত্রে সুদের হারও হবে ৯ শতাংশ। এই সুদের ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে পরিশোধ করবে।

এছাড়া, শল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩৫০ কোটি, বস্ত্র খাতের জন্য ৬০ কোটি প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্সিংয়ে ৬০ কোটি ডলারের তহবিল করার ঘোষণাও দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রপ্তানি সহায়তার পরিমাণও ৩৫০ কোটি ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫০০ কোটি ডলার করা হয়। 

কিন্তু প্রণোদনা বাস্তবায়নে অর্থের ঘাটতিতে পড়তে হবে। যে কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে যে ঘাটতি (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট), তা পূরণে এবং বাজেট সহায়তার জন্য এই উন্নয়ন সহযোগীর দিকে ফিরতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

জানুয়ারি পর্যন্ত গত সাত মাসে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ক্ষেত্রে ১৩ কোটি ২০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত দেখা গেলেও সামনের মাসগুলোতে চাপ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। 

কারণ করোনাভাইরাসের আঘাতে বিপর্যস্ত ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে মার্চ মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের শিপমেন্ট ৩০ শতাংশ কমে গেছে। বর্তমানে এই তৈরি পোশাকই বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত।

এদিকে সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সফলতা নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছেন না বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

তার মতে, কোভিড-১৯ এবং চার কোটি দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা- এই দুটি মূল বিষয় বাদ দিয়ে শুধু অর্থনীতি পুনরুদ্ধারেই বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। 

নিক্কেইকে তিনি বলেন, “আপনি মহামারীকে জিইয়ে রেখেই অর্থনীতি পুনর্গঠনের চেষ্টা করছেন, এটি একটি দুর্বল কৌশল। প্রধান বিষয়টিতেই (রোগ নিয়ন্ত্রণ) কম মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।”

তাছাড়া ব্যাংকগুলোর বাড়তি আয়ের পথ না থাকলে প্রণোদনা তহবিল গঠন কিভাবে হবে তা নিয়েও সন্দিহান তিনি। কারণ আগামী ছয় মাস ব্যাংকগুলো কোনো অর্থ জমা নিতে পারবে না এবং ঋণের অর্থ সংগ্রহে স্থবিরতার কারণে তাদের আয়ও বাধাগ্রস্ত হবে। 

ব্যাংকগুলো কিভাবে অর্থের যোগান দেবে, কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ধরনের পুনঅর্থায়ন করবে কিনা সে বিষয়ে সরকার ঘোষিত প্রণোদনায় পরিষ্কার দিকনির্দেশনা নেই।     

সমস্যার উদাহরণ দিতে গিয়ে আহসান এইচ মনসুর ব্যাংক পরিচালকদের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা নিজেরাই তহবিলের প্রায় পুরোটাই নিয়ে নিতে পারেন।

“বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা বিপজ্জনক। যেসব প্রতিষ্ঠানের দরকার তারাই হয়ত ঋণ পাবে না।”

মনসুরের হিসাবে, প্রণোদনার ৬১২ কোটি ডলার বড় বড় কোম্পানি আর ২৬০ কোটি ডলার রপ্তানিকারদের পকেটেই চলে যাবে। 

ব্যবসা-বাণিজ্যকে টিকিয়ে রাখতে প্রণোদনা ঘোষণা করা হলেও তা কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তার ওপর সাফল্য নির্ভর করছে বলে মনে করেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

“শ্রম আয়ে সহযোগিতা মিললেও প্যাকেজটি বেকারত্ব এবং দেউলিয়াত্ব থেকে সুরক্ষা দেবে কিনা সেটাই মূল বিষয়।”

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি শামস মাহমুদ প্রণোদনা প্যাকেজকে স্বাগত জানালেও সত্যিকারের উদ্যোক্তারা যাতে আর্থিক রসদ পায় সেটা নিশ্চিত করাই এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব বলে মনে করেন।

“কারণ অর্থনীতিতে এখন ধীরগতি। জর্মানিসহ অন্যান্য দেশের মতোই রপ্তানি কমে গেছে,” বলেন তিনি।

তবে সাময়িক এই ধাক্কা সামলে ভবিষ্যতে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদী তিনি। 

গত মাসেও বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন অবকাঠামো ব্যাংকসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে বাজেট সহায়তা চেয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ জানিয়েছে।

আইএমএফের স্থানীয় প্রতিনিধি গুডমান্ডসন বলছেন, সমন্বিত এসব সহায়তায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল করার মাধ্যমে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতে পারে।”

উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার (৮% শতাংশের বেশি), নিম্ন মূল্যস্ফিতী (৫ শতাংশের কিছু বেশি) এবং অর্থবছরের সহনীয় ঘাটতির (৫% এর কিছু বেশি) ওপর ভিত্তি করেই সামষ্টিক অর্থনীতিতে সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।