প্রণোদনার অর্থ যেন খেলাপিরা না পায়,  সতর্ক করলেন অর্থনীতিবিদরা

নভেল করোনাভাইরাস মহামারীতে অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় সরকারের ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ ঋণ খেলাপিদের হাতে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 April 2020, 10:28 AM
Updated : 12 April 2020, 12:44 PM

তারা বলছেন, স্বল্প সুদের এই প্রণোদনা ঋণ যাতে খেলাপিরা না পায় এবং ঋণ যাতে পুরো আদায় হয় সে বিষয়ে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক থাকতে হবে।

এবিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে নীতিমালা তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন দুই অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এবং আহসান এইচ মনসুর।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্যাকেজ ঘোষণার পর প্রশ্ন উঠেছিল ব্যাংকগুলো এতো টাকার যোগান পাবে কোত্থেকে। বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপো সুদহার এবং সিআরআর (নগদ জমা সংরক্ষণের হার) কমানোয় সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে।

“এখন সেই অর্থের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা হচ্ছে- বিশাল অংকের খেলাপি ঋণ। এই প্রণোদনা প্যাকেজের একটি টাকাও যেন খেলাপি না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করেই ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণ করতে হবে ।”

সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকার সঠিক পথেই  রয়েছে বলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তবে তিনিও প্রণোদনা তহিলের যাতে খেলাপির হাতে না যায় সে বিষয়ে সরকারের শীর্ষ মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যারা বিশেষ সুবিধা নিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন, যাদের ঋণ রাইট অফ (অবলোপন) করা হয়েছে এবং আদালতে যাদের মামলা বিচারাধীন, তারা যেন এই প্যাকেজ থেকে একটি পয়সাও ঋণ না পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আর তা করা হলেই প্রণোদনা প্যাকেজের সুফল পাবে বাংলাদেশ।”

৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতার জন্য আগে ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিলের সঙ্গে নতুন চারটি প্যাকেজে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টর,ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন ঋণ সুবিধা,এক্সপোর্ট ডেভলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সুবিধা বৃদ্ধি এবং প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম চালুর ঘোষণা দেন।

সরকারের হাতে এতো উদ্বৃত্ত অর্থ না থাকায় প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোর কাছে তারল্যের পরিমাণ বাড়াতে বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) ও রেপো সুদহার কমিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।এর ফলে তাদের কাছে বিতরণযোগ্য অর্থের যোগান বাড়বে।

মির্জ্জা আজিজ বলেন, ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজটি সার্বিকভাবে একটি কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ। করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনীতি যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। তাই সার্বিক বিবেচনায় এ সময়ে এমন একটি প্রণোদনা দরকার ছিল।

“তবে এখন যে প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে সেটি হলো কারা অর্থ পাবেন, যথাযথভাবে প্রণোদনার অর্থ দেওয়া হবে কি না—এসব নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। দেখা যাবে, ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে যাদের পাওয়ার কথা, তারা হয়তো না-ও পেতে পারেন। রাজনৈতিক প্রভাব বা অন্য কোনো সম্পর্কের কারণে যাদের সুবিধা পাওয়ার কথা নয়, তারাও ঋণ পেয়ে যেতে পারেন।

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এই মহাসংকটের সময়ে প্রতিটি টাকার যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। আমরা বিভিন্ন সময়ে শুনেছি, ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে এই দেশে, ওই দেশে পাচার করা হয়েছে। এমনটি যেন না হয় সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারকে কঠোর হতে হবে।

“যাদের অতীত ইতিহাস ভালো নয়, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নানান ফাঁকফোকড় বের করিয়ে নিয়ে ঋণ রিসিডিউল (পুনঃতফসিল) করেছেন; আদালতে গিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা আটকে রেখেছেন তারা যেন এই প্যাকেজের টাকা না পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

“কোনো ব্যাংকের পরিচালক যেন এই প্যাকেজ থেকে ঋণ না পায় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। যদি এ সব না করা হয়; তাহলে কিন্তু ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকিং খাতের সংকট আরও বাড়বে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো মোট ঋণ ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা।

অর্থাৎ ব্যাংকগুলো ডিসেম্বর পর্যন্ত যত টাকার ঋণ বিতরণ করেছে তার ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।