গত আট মাস ধরে টানা নামছে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি।আর চড়ছেই সরকারের ঋণের বোঝা।যাকে অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের বলছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার ব্যাংকিং খাতের ঋণের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, জানুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৫২ হাজার ৪৭৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এই অংক গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে ৯ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে এই একই সময়ে ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া মোট ঋণের স্থিতির পরিমাণ হচ্ছে এক লাখ ৬৩ হাজার ২৫৫ কোটি ১০ লাখ টাকা।যা ২০১৯ সালের জানুয়ারির চেয়ে ৬৫ দশমিক ০৫ শতাংশ বেশি।
তথ্য ঘেটে দেখা যায়, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর সরকারের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
আর এটাকেই ‘এই মুহূর্তে’ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও আহসান এইচ মনসুর।
২০০৭-০৮ মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা মির্জ্জা আজিজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা খুবই উদ্বেগের যে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যা মুদ্রানীতির লক্ষ্যের চেয়ে অনেক কম।”
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমনিতেই বিনিয়োগের অবস্থা খারাপ।বেশ কিছুদিন ধরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কম।তার উপর ব্যাংক থেকে সরকার প্রচুর ঋণ নেওয়ায় এই প্রবাহে আরও টান পড়েছে।”
দু’জনই বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ‘তছনছ’ হয়ে যাচ্ছে।তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে।আমদানি-রপ্তানি কমছে।সবমিলিয়ে অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন তারা।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। ওই মন্থর গতির কারণে গত বছরের ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯-২০ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে, তাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ ধরা হয়।
মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর ফজলে কবির বলেছিলেন, “আগের মুদ্রানীতিতে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হলেও অর্জিত হয়েছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। তা থেকে বাড়িয়ে এবার ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে।”
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ার যে লক্ষ্য ধরেছে, বর্তমান অঙ্ক তার থেকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ পয়েন্ট কম।
অন্যদিকে মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয় ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ।বাড়তে বাড়তে জানুয়ারি শেষে তা ৬৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
“তানাহলে কিন্তু আমাদের সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।”
“ঋণ প্রবাহ কমা মানে দেশে বিনিয়োগ কম হচ্ছে।ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না।”
ব্যাংক থেকে সরকারের লাগামহীন ঋণ নেওয়ার কারণে বেরসকারি খাত বঞ্চিত হচ্ছে মন্তব্য করে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনসুর বলেন, বাজেটে সরকার পুরোবছরের জন্য যে ঋণ নিতে চেয়েছিল তা ৫ মাসেই নিয়ে ফেলেছে। অবস্থা যা মনে হচ্ছে, অর্থবছর শেষে এবার সরকারের ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
“তাহলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে কোথায়? সুদের হার কমলেই কী খুব লাভ হবে?”
“একটা বিষয় সবাইকে মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না।আর কর্মসংস্থান বাড়ানোই এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”
অক্টোবরে ছিল ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ।সেপ্টেম্বরে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস জুলাইয়ে ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ।
তার আগে জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ; মে মাসে ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ।এপ্রিলে ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মার্চে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ।
জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার।
লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আদায় এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে বাধ্য হয়েই সরকারকে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিতে হচ্ছে, বলেন আহসান মনসুর।