৭ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ৯.৬ বিলিয়ন ডলার

পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি বাড়ছে।আমদানি ব্যয় কমার পরও বাণিজ্য ঘাটতি কমছে না।রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধাক্কার কারণে এই ঘাটতি বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2020, 01:53 PM
Updated : 7 March 2020, 01:54 PM

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬৪ কোটি ৩০ লাখ (৯.৬৪ বিলিয়ন) ডলার। গত বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল প্রায় একই; ৯৮৭ কোটি ৩০ লাখ কোটি ডলার।

আমদানি কমায় অর্থবছরের তিন মাস পর্যন্ত পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি আগের অর্থবছরের চেয়ে কম ছিল।২০১৮-১৯ অর্থছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ঘাটতি ছিল ৩৮৫ কোটি ২০ লাখ ডলার।২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ছিল তার থেকে কম ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

তবে রপ্তানি আয়ে ধসের কারণে এর পর থেকেই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে; এমনকি আমদানি ব্যয় কমার পরও বাড়ছে এই ঘাটতি।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) মোট তিন হাজার ২০০ কোটি ২০ লাখ (৩২ বিলিয়ন) ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। আর পণ্য রপ্তানি থেকে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) আয় করেছে দুই হাজার ২৩৫ কোটি ৯০ লাখ (২২.৩৬ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবেই বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

তথ্যে দেখা যায়, এই সাত মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আর রপ্তানি আয় কমেছে ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পুরো সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫৪৯ কোটি ৪০ লাখ (১৫.৪৯ বিলিয়ন) ডলার।২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ১৮ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, বিগত বছরগুলোতে আমদানি খাতে ব্যয় বাড়ার কারণে রপ্তানি আয় বাড়লেও বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু এবার আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয় কমায় বাড়ছে এই ঘাটতি।

সেবা খাতের ঘাটতি ২.১৯ বিলিয়ন ডলার

সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। জুলাই-জানুয়ারির সময়ে এ খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২১৯ কোটি ১০ লাখ (২.১৯ বিলিয়ন) ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১৮৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।

লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ১.৫২ বিলিয়ন ডলার

জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫১কোটি ৬০ লাখ (১.৫১ বিলিয়ন) ডলার।

গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪০৪ কোটি ১০ লাখ ডলার। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই ঘাটতি ছিল ৬৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

অথচ অগাস্ট মাস শেষেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, রপ্তানি আয়ে ধস নামার কারণে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। একই কারণে আমদানি কমার পরও চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, গত দুই অর্থবছরে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় ঘাটতি নিয়ে বছর শেষ হয়েছিল। কিন্তু এবার অর্থবছর শুরু হয়েছিল ‘স্বস্তির’ মধ্য দিয়ে ২৪ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে। অগাস্ট পর্যন্ত সেই উদ্বৃত্ত ধরে রাখা গিয়েছিল।

“কিন্তু রপ্তানিতে বড় ধাক্কার কারণে সেটা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। গত দুই বারের মতো এবারও মনে হচ্ছে বড় ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কেননা, সহসা রপ্তানি আয় ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।”

“উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, রপ্তানিতে একটার পর একটা সমস্যা লেগেই আছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতিকে তছনছ করে দিচ্ছে এই রোগ।কোথায় গিয়ে থামবে; কি হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।”

সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত

তবে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত রয়েছে বাংলাদেশের। ১৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে অর্থবছরের সাত মাস শেষ হয়েছে।

অথচ পাঁচ মাস শেষেও (জুলাই-নভেম্বর) ৩০ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঘাটতি ছিল।

তবে আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।জুলাই-জানুয়ারি সময়ে এই উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ২১৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ৩৬৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

চলতি হিসাবের ভারসাম্য ৫২৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বড় ঘাটতি (ঋণাত্মক) নিয়ে শেষ হয়েছিল গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ৯৫৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হল, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

রেমিটেন্স বেড়েছে ২১.৪৮ শতাংশ

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ৯০৯ কোটি ৩০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে এক হাজার ১০৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

শতাংশ হিসেবে এই সাত মাসে রেমিটেন্স বেড়েছে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

এফডিআই বেড়েছে ৪%

গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।

গত অর্থছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ৩০৮ কোটি ৫০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশে। এই অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৩২২ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

এ হিসাবে সাত মাসে এফডিআই বেড়েছে ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বাংলাদেশে নিট এফডিআই এসেছে ১৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। আগের বছরে একই মাসে এসেছিল ১৬১ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে।

পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগে ‘করুণ দশা’

তবে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত অর্থবছরেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল হতাশাজনক।এবার তার চেয়ে খারাপ।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে পুঁজিবাজারে মাত্র ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল প্রায় দ্বিগুণ; ৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

জুলাই-জানুয়ারি সময়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ বাংলাদেশে এসেছে ২৯৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার।আগের বছরের এই ছয় মাসে এসেছিল ৩১১ কোটি ৬০ লাখ ডলার।