শিক্ষিত তরুণদের কৃষিতে নজর ফেরানোর আহ্বান

শিক্ষিত তরুণদের কৃষি ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে অর্থনীতিবিষয়ক একটি আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Feb 2020, 11:56 AM
Updated : 3 Feb 2020, 11:56 AM

সোমবার ঢাকাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং- সানেম আয়োজিত অর্থনীতিবিদদের পঞ্চম বার্ষিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘রিপ্লেক্টিং ইয়ুথ পারসপেক্টিভ অন ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক এই আলোচনায় রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজ উন্নয়নকর্মী, উদ্যোক্তা এবং শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।

শরীয়তপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক বলেন, “জনপ্রতিনিধি হওয়ার কারণে অনেক তরুণ চাকরির জন্য আসেন। তারা সরকারি চাকরি আর ব্যাংকের চাকরির জন্য আগ্রহ দেখান। কিন্তু কেউই কৃষক কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার হতে চান না।

“আমাদের দেশে অনেকেই দেখি কর্মহীন প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলে। কিন্তু তরুণ সমাজ নিজে থেকে কিছু করার আগ্রহ দেখায় না। বরং বিদেশে পাড়ি জমাতে তাদের আগ্রহ বেশি।”

বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর হলেও গত দুই দশকে তা পরিবর্তিত হচ্ছে। ২০০০-২০০১ অর্থবছরে দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ২০ দশমিক ৮ শতাংশ; ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ১ শতাংশে।

কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্ব দিয়ে ফেরদৌস বায়োটেকের প্রতিষ্ঠাতা ফারজিন ফেরদৌস আলম বলেন, ”পোশাক রপ্তানি আর বিদেশ থেকে অদক্ষ শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সকে বড় করে দেখা হলেও বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির মূল ভিত্তি হিসাবে কৃষি এখনও প্রধান ভূমিকায়।”

এই খাতে তরুণদের আগ্রহী করতে পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্ব দেন তিনি।

“নানামুখী সামাজিক ও বাজার ব্যবস্থাপনার বাধার সম্মুখীন হচ্ছে কৃষিখাত। শিক্ষিত তরুণদের এই পেশার প্রতি যথেষ্ট অনীহা আছে। এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে অথবা কৃষিকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যাতে শিক্ষিত তরুণরা নতুন নতুন উদ্ভাবন নিয়ে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হয়।

“বর্তমানে যারা কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত আছে তাদের আয় বাড়াতে এবং তারা যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। তাহলে কেবল তারা স্বাচ্ছন্দে নিজের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারবে এবং কৃষির প্রতি ওই সন্তানের একটা আগ্রহ সৃষ্টি হবে।”

পাশাপাশি তরুণদেরও নিজে থেকে উদ্যোগী হওয়া আহ্বান জানান ফারজিন ফেরদৌস।

“নতুন প্রজন্মের কেউ উদ্যোক্তা হতে চাইলে সবার আগে নিজে নিজেই কাজে নেমে পড়তে হবে। উদ্যোক্তা হওয়া মানে নিজেই নিজেইর অফিসের কর্তা বনে যাওয়া নয়। গতকালকেও আমি মাঠে কৃষক সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করে এসেছি; আজ এখানে বক্তব্য দিচ্ছি,” শিক্ষার্থী শ্রোতাদের উদ্দেশে বলেন তিনি। 

কৃষিতে তরুণদের উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ফারজিন ফেরদৌস বলেন, “তরুণরা কেবল ঢাকায় চলে আসতে চায় অথবা মনের মধ্যে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার বাসনা নিয়ে ঘুরে। তার কেউ কৃষিকাজে আগ্রহ পায় না। মাঠে যারা কৃষিকাজ করেন তাদের অধিকাংশের বয়স ৪০ বছরের বেশি। মাত্র ২০ শতাংশ কৃষিকর্মী পেয়েছি যাদের বয়স ৩৫ বছরের নিচে।

“কৃষক এখনও সমাজে করুণার পাত্র। কেউ তাদের মর্যাদার কথা বলে না। কৃষকের সামাজিক এবং আর্থিক মর্যাদা বাড়ালে তরুণরা এইদিকে ঝাঁপিয়ে পড়বে, যেমনি ভাবে এখন সরকরি চাকরির দিকে ঝুঁকে পড়েছে।”  

তরুণদের উৎসাহ দিয়ে রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাও লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী ইলিয়াস হোসেন বলেন, ”সমমনা একদল তরুণের কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের ফলেই আজকের পাঠাও দাঁড়িয়েছে। এটি সম্পূর্ণ দেশীয় প্রচেষ্টার একটি উদাহরণ যা দেশের বাইরের বন্ধুদেরকেও অবাক করে। ২০১৭ সালে পণ্য সরবরাহ সেবা দিয়ে শুরু করা পাঠাও এখন আজকের অবস্থানে এসেছে।” 

বাংলাদেশের সর্বত্র দেশীয় উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার অভাব রয়েছে উল্লেখ করে ইলিয়াস বলেন, ”গার্মেন্টেস আমাদের রপ্তানির সবচেয়ে বড় খাত হলেও এই শিল্পেও আমরা পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারিনি। যেই পোশাক রপ্তানির জন্য তৈরি করা হয় তার ডিজাইনটা বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান করে দিচ্ছে। এসব খাতে তরুণদের এগিয়ে আসার সুযোগ আছে।”

এশিয়া ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ বলেন, ”দেশের ভেতরে কাজের অনেক সুযোগ থাকলেও এর জন্য দক্ষ জনশক্তির এখনও অভাব রয়েছে। সেজন্য ভবিষ্যতে সুনির্দিষ্ট দক্ষতা সম্পন্ন জনশক্তি গড়ে তুলতে নতুন কারিকুলাম সাজাতে হবে।”

ব্র্যাকের পরিচালক নবনীতা চৌধুরী বলেন, ”দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই হচ্ছেন নারী। তাদের বাদ দিয়ে কোনো দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তব বিষয় হচ্ছে ঘরে এবং ঘরের বাইরে সর্বত্র নারীরা হয়রানি আর বাধার মুখে পড়ছে। তাদের এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।

“এখন শতকরা ৮০ জন নারী স্বামীর ঘরে নির্যাতনের শিকার। ঢাকার গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে ৯০ শতাংশ নারীর। কেবল কর্মস্থলেই বিভিন্ন রকম নির্যাতনের শিকার হন ২২ শতাংশ নারী।”

আলোচনা সভার সঞ্চালনায় ছিলেন সানেমের গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক বিদিশা হক।

রোববার মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে সম্মেলনের প্রথম দিনের অধিবেশনের পর এদিন দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন বসে গুলশান স্পেকট্রা কনভেনশন সেন্টারে।

সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে সামষ্টিক অর্থনীতি, বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন, শ্রমবাজার, দারিদ্র্য ও বৈষম্য বিষয়ে ৬৫ জন গবেষক তাদের গবেষণাকর্ম উপস্থাপন করেন। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপালের ২৭ জন গবেষক এতে অংশ নেন।